নিজস্ব প্রতিবেদক:
চরম ক্রান্তিকাল পেরিয়ে যুবলীগ তার নতুন কান্ডারির সন্ধান পেল গতকালের সপ্তম সম্মেলনে। নতুন এই কান্ডারি হলেন ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের ভাই শেখ পরশ। এই সম্মেলনেই শেখ পরশ যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার পেলেন। আগামী তিন বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করবেন। গত কয়েক মাস ধরে ভাবমূর্তি প্রায় ভেসে যাওয়ার মতো নানা উত্থানের পতনের মধ্যদিয়ে যুবলীগের পথ চলা। গতকালের সম্মেলনের মধ্যদিয়ে যুবলীগ আবার পূর্ণতা পেল বলে মনে করছেন দলটির তৃণমূল নেতারা।
গতকাল শনিবার সকাল থেকে যুবলীগের সম্মেলন শুরু হয় ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বাদ দিয়ে। সকাল ১১টায় সম্মেলন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় যুবলীগের কংগ্রেসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কতটুকু পেলাম, কী পেলাম না, এটা নয়, কতটুকু কাজ করতে পারলাম, সেটাই হবে রাজনীতিবিদের চিন্তা। এই চিন্তা মাথায় রেখে যারা রাজনীতি করে, তারাই সফল হবে। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শে যারা থাকতে চায়, তাদের এই চিন্তা নিয়েই চলতে হবে। দুর্নীতি করে কেউ টাকা বানাতে পারে, এই টাকা দিয়ে জৌলুস করতে পারে, চাকচিক্য বাড়াতে পারে, আন্তর্জাতিক বড় বড় ব্র্যান্ডের জিনিস পরতে পারে। কিন্তু তাতে সম্মান পাওয়া যায় না। মানুষ হয়তো অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকাতে পারে। কিন্তু মর্যাদা পাওয়া যায় না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’ গতকাল শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেসে (সম্মেলন) প্রধান অতিথি হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি এসব কথা বলেন। দুপুর দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের সব নেতাকর্মীসহ যুবসমাজকে মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। সবাইকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবাইকে আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। এর মাধ্যমে সংগঠন যেমন চলতে পারে, দেশকেও কিছু দেওয়া যায়।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে। ক্ষমতা আগে দখল করে, উড়ে এসে জুড়ে বসাদের ক্ষমতার উচ্ছিষ্টের ভাগ দিয়ে এই সংগঠন গড়ে ওঠেনি। এই সংগঠন গড়ে উঠেছে নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের জন্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের লক্ষ্য নিয়ে। এই আদর্শ থেকে যারা বিচ্যুত হয়, তারা দেশকে কিছু দিতে পারে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের চলার পথে, উন্নয়নের পথে যদি কেউ বাধা দেয়, তাহলে তাকে আমি ছাড়বো না। সে যেই হোক, সে কোনও সহানুভূতি পাবে না। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।’
তিনি বলেন, ‘যুবলীগ এই দেশে রাজনৈতিকভাবে অনেক অবদান রেখেছে। প্রত্যেকটা আন্দোলনে যুবলীগ ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধে এই যুবকরাই তো বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। তবে যুবকরা যেন দেশের কল্যাণে কাজ করে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ থেকে অনুপ্রাণিত হতে তিনি সবাইকে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটি পড়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর এই দুটি বই পড়তে বলবো। এছাড়া ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার সব রিপোর্ট আমি প্রকাশ করছি। পৃথিবীতে এটা কখনও হয়নি। তবে এটার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান বের হয়ে আসবে। ইতোমধ্যে চারটি খন্ড বের হয়েছে। ১৪টা খন্ড বের হবে। এটার মধ্য দিয়ে বের হবে তিনি বাঙালি জাতির জন্য কী করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকিস্তানিরা দেশকে ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের দায়িত্ব নিলেন বঙ্গবন্ধু। শূন্যহাতে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি দেশটিকে আবার গড়ে তোলেন। রাস্তাঘাট, সেতু, স্কুল-কলেজ চালু করেন। ঘরে ঘরে নির্মাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। মাত্র ৯ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। এমনভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন যে দেশ স্বল্পোন্নত দেশের স্বীকৃতি পেয়েছিল। সাত ভাগ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। একটি প্রদেশ যা ছিল শোষিত-বঞ্চিত, সেটিকে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘যাদের দুর্নীতিটাই ছিল নীতি, যে এতিমের টাকা আত্মসাতের দায়ে কারাগারে, যার ছেলে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, মানি লন্ডারিং মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, তারা কী করেছে দেশের জন্য।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু লোভ লালসার ঊর্ধ্বে উঠে একটি দেশ সৃষ্টি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ। কতটুকু পেলাম তা নয়, কতটুকু কাজ করতে পারলাম, সেটা ভাবতে হবে। এই চিন্তা মাথায় রেখে যারা রাজনীতি করে, তারা সফল হবে। যারা দুর্নীতি করে জৌলুস করতে পারে, চাকচিক্য দেখাতে পারে, তারা কিন্তু সম্মান পায় না। দেশের মানুষের কাছে মর্যাদা পাওয়া যায় না।
পরশ যুবলীগের নতুন চেয়ারম্যান
আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নতুন কমিটির চেয়ারম্যান হলেন শেখ ফজলে শামস পরশ। আগামী তিন বছর যুবলীগের নেতৃত্ব দেবেন তিনি।
ক্যাসিনোকান্ডে বিদায় নেয়া যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী হলেন পরশের ফুপা।
পরশের ভাই শেখ ফজলে নূর তাপস আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। তাদের চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য। তিনিও যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন।
পঁচাত্তর ট্রাজেডিতে বাবা-মাকে হারানো পরশ ধানমন্ডি সরকারি বালক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজের থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার পর দেশে ফিরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আসছিলেন তিনি।
ভাবমূর্তি সঙ্কটে থাকা যুবলীগকে উদ্ধারে ফুপু শেখ হাসিনার নির্দেশে পরশ এবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন বলে আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত পরশ যুবলীগের নতুন চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছেন বলে আগে থেকেই গুঞ্জন ছিল। সম্মেলন প্রস্তুতির জন্য যুবলীগের যে কমিটি হয়েছে, তাতে আকস্মিকভাবে পরশের যুক্ত হওয়া দেখে সবার আলোচনায় আসে তার নামটি। সম্মেলনের অভ্যর্থনা উপকমিটির বৈঠকে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কার্যালয়ে তিনি গেলে কর্মীরা করতালি দিয়ে তাকে ‘পরবর্তী চেয়ারম্যান’ হিসেবে শুভেচ্ছা জানায়।
সেরা নিউজ/আকিব