নিউজ ডেস্ক: বাবা ইবাদত আলী হোটেল কর্মচারী। তিন মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। সংসারের খরচ কমাতেই বড় মেয়ে ইতি খাতুনকে বাল্যবিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিয়ের আয়োজনের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে বরপক্ষও এসেছিল চুয়াডাঙ্গায় ইতিদের বাড়িতে। শাড়ি পরা ইতিকে দেখে পছন্দও হয়ে যায় বরপক্ষের। বাকি ছিল শুধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ূয়া ইতি কোনোমতেই বিয়ে করতে রাজি নন। তবে ১১ বছর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ের কথা কেই বা শুনবে! তাই বাড়ি থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজছিলেন। ঠিক ওই সময় খবরটা আসে তার কানে। যাদের সঙ্গে সকাল-বিকেল তীর-ধনুক নিয়ে বনেবাদাড়ে খেলতেন, সেই বন্ধুবান্ধবের কাছেই শোনেন, আরচারির প্রতিভা অন্বেষণ চলছে তাদেরই শহরে। ইতি যেন এই সুযোগই খুঁজছিলেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যোগ দেন আরচারির ক্যাম্পে। কনে পালিয়ে যাওয়ায় স্বভাবতই বিয়ে ভেঙে যায়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরচারির সেই ক্যাম্পে বাছাইয়ে হয়েছিলেন প্রথম। বদলে যায় তার জীবন। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসা ১৪ বছরের এ মেয়েটিই এখন আরচারিতে বাংলাদেশের সোনার মেয়ে। সাউথ এশিয়ান গেমসে পোখারায় গতকাল রিকার্ভ নারী দলগত এবং রিকার্ভ মিশ্র দলগত ইভেন্টে স্বর্ণ জিতেছেন। ব্যাংককে এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে ভুটানের কর্মের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। টোকিও অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করা কর্মকে এসএ গেমসের রিকার্ভ নারী ব্যক্তিগত ইভেন্টের সেমিফাইনালে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন ইতি। সরাসরি ৬-০ সেটে ভুটানের এই প্রতিযোগিকে বিধ্বস্ত করা ইতি অতীত হারের প্রতিশোধ নিয়েছেন। আর গতকাল পোখারায় নারী দলগত ইভেন্টে বিউটি রায়, মেহনাজ আক্তার মুন্নির সঙ্গে জুটি বেঁধে শ্রীলংকাকে ৬-০ সেটে হারিয়ে দেন। বিস্ময় বালিকাখ্যাত ইতি এরপর জুটি বাঁধেন প্রথম আরচার হিসেবে সরাসরি অলিম্পিকে খেলা রোমান সানার সঙ্গে। মিশ্র দলগত ইভেন্টে ভুটানকে ৬-২ সেট পয়েন্টে হারিয়ে সোনালি হাসি হাসেন ইতি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথম স্বর্ণ জেতা ইতির উচ্ছ্বাসটা একটু বেশিই। তবে কথা বলার সময় অনেকটা লাজুক প্রকৃতির। স্বর্ণ জয়ের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে যেন একটু লজ্জাই পেলেন চুয়াডাঙ্গার এ তীরন্দাজ, ‘স্বর্ণ জিততে পেরেছি বলে ভালো লাগছে। আমি কখনোই আশা করিনি যে, দুটি স্বর্ণ জিতব। কয়েকটি পদকের আশা করেছিলাম। প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যাওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত।’ মাত্র তিন বছর হলো আরচারিতে আসা। এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক সাফল্য। এখন রিকার্ভ নারী ব্যক্তিগত ইভেন্টের ফাইনাল। সোমবার এই ইভেন্টে ট্রেবল জয়ের স্বপ্নপূরণ হয়েছে ইতির। খুব আশাবাদী ছিলেন ইতিও, ‘যেহেতু দুটি স্বর্ণ হয়ে গেছে, আমি এখন আশা করি, কালও ভালো করতে পারব।’ নিজের পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিতেই লজ্জায় মুখ লুকানোর চেষ্টা ইতির। বিয়ে ভেঙে দেওয়ার সেই স্মৃতিটা এখন আর মনে করতে চান না ১৪ বছরের এ তীরন্দাজ, ‘হ্যাঁ, একসময় আমার বাবা আমাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তখন আমি রাজি ছিলাম না। তখন তারা বলতেন, মেয়ে হয়েছিস কিসের খেলা। তবে এখন আমাকে অনেক আদর করেন। আমার সাফল্যে তারা গর্বিত।’ ইতির সাফল্যে গর্বিত বাংলাদেশ আরচারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজিব উদ্দিন আহমেদ চপলও, ‘ইতি একটা বিস্ময় বালিকা। কারণ এত অল্প বয়সে এখানে এবার কেউ খেলছে না। তাকে যখন আমরা উঠিয়ে আনি, তখন বুঝতে পারি, ইতি কী জিনিস। তীরন্দাজ সংসদের হয়ে খেলা এ মেয়েটি অবিশ্বাস্যভাবে উন্নতি করেছে। আরচারির লাইফে এক সজীব করেছিল, এবার ইতি।’
সেরা নিউজ/আকিব