আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বিমান হামলা চালিয়ে শুক্রবার ইরানের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সোলেইমানি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের বিভিন্ন সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এখন তার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এ অঞ্চলে তেহরান এবং ওয়াশিংটনের উত্তেজনা আরও বাড়ল।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপের অর্থ কি? সেই প্রশ্নের উত্তর জানিয়েছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিকবিষয়ক প্রতিবেদক জোনাথন মার্কাস।
এ হত্যাকাণ্ড কীভাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা বাড়িয়ে তুলতে পারে?
সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডকে কেউ কেউ ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাদের এই বলাটাকে অত্যধিক হিসেবে নেয়া কিংবা গুরুত্ব না দেয়া উভয়ই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে গড়াবে না। এ ধরনের সংঘাতে যারা ক্রীড়ানক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে; যেমন রাশিয়া এবং চীন। তারা এই নাটকের তাৎপর্যপূর্ণ খেলোয়াড় নয়।
তবে এ নাটকে মধ্যপ্রাচ্য এবং ওয়াশিংটনের ভূমিকা সংজ্ঞায়িত করার মতো এক ধরনের মুহূর্ত তৈরি হতে পারে। ইরান এ ঘটনায় প্রত্যাশিতভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিশোধ নিতে পারে এবং এটি মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার মতো একটি চক্রের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যার পরিণতিতে দুটি দেশ একেবারে সর্বাত্মক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতেও পারে।
ইরানের প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়া অবশ্যই এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্বার্থের ওপর হতে পারে। একই সঙ্গে ইরান নিজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে মনে করে এমন যেকোনো মার্কিন স্বার্থের ওপরও আঘাত হানতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইনে কাউকে হত্যা কি বৈধ?
যুক্তরাষ্ট্র যুক্তি দিচ্ছে, সোলেইমানি ইরাকে মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলার জন্য দায়ী। ইরাকের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অনুরোধে মার্কিন সেনারা সেখানে ছিল। সোলেইমানি এমন একজন ব্যক্তি; ওয়াশিংটন যাকে মনে করে যে, অনেক মার্কিন সৈন্যের রক্তের দাগ তার হাতে রয়েছে। অন্যদিকে সোলেইমানি নেতৃত্বাধীন ইরানের কুদস ফোর্সকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে। সুতরাং তাকে হত্যার ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র বৈধ হিসেবে হাজির করতে পারে।
কিন্তু প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ নটর ডেম ল’ স্কুলের অধ্যাপক ম্যারি এলেন ও কনেল এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তার মতে, আগ বাড়িয়ে আত্মরক্ষার নামে কোনো হত্যাকাণ্ড আইনি বিচারে বৈধ হিসেবে পার পেতে পারে না। এটা হতে পারে না। জাতিসংঘ সনদের এ সংক্রান্ত আইনে বলা হয়েছে, প্রকৃত এবং মৌলিক সশস্ত্র হামলার জবাবেই কেবল আত্মরক্ষাকে অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, বাগদাদে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা যুক্তরাষ্ট্রে তেহরারে সশস্ত্র হামলার জবাবে ছিল না। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌম ভূখণ্ডের কোথাও আক্রমণ চালায়নি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র শুধু একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডই ঘটায়নি বরং তারা ইরাকের ভেতরে বেআইনি হামলা পরিচালনা করেছে।
কাসেম সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডে জাতিসংঘের অবস্থান কি?
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামতের বাইরে এ হত্যাকাণ্ড ঘিরে জাতিসংঘের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে তা আসলেই বলা মুশকিল। এর মাধ্যমে আসলে কি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝায়? যদি তাই হয়, তাহলে নিরাপত্তা পরিষদের অবস্থান এতে হবে বিভক্ত। কারণ একপক্ষ হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে গেলে অন্যপক্ষ হত্যাকাণ্ডের বৈধতার সাফাই গাইবে।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেসের মুখপাত্র ফারহান হক এক বিবৃতিতে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় তিনি (জাতিসংঘ মহাসচিব) গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এটা এমন একটি মুহূর্ত, যেখানে বিশ্ব নেতাদের সর্বোচ্চ সংযম দেখানো জরুরি। উপসাগরীয় অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধের ভার বহনের সক্ষমতা বিশ্বের নেই।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিশংসনের বিচার প্রক্রিয়া থেকে দৃষ্টি সরাতেই কি এই হত্যাকাণ্ড?
এ ধরনের অভিযোগ আনা কিংবা ধারণা পোষণ করা কঠিন কোনো কিছু নয়। কিন্তু দেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনী বছরের সময়, তখন এ সিদ্ধান্ত দুটি চিন্তার ফসল হতে পারে। এক. সুযোগ এবং দুই. পরিস্থিতি।
পরিস্থিতি দেখে এটা ধারণা করা যেতে পারে, ইরাকে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন স্থাপনার ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ হামলার আশঙ্কায় পেন্টাগন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি এ মুহূর্তে অর্থনৈতিকভাবে টানাপড়েনের মধ্যে থাকা ইরানের প্রতিক্রিয়া যে সর্বাত্মক হবে না; সেটিও সোলাইমানির ওপর হামলার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে হাজির হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।
নির্বাচনের বছরে এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মূল চিন্তার বিষয় ছিল এ অঞ্চলে মার্কিন প্রাণহানি এড়ানো। নাটকীয় এ হামলা বিভিন্নভাবে মনে হতে পারে যে, একজন প্রেসিডেন্ট কঠোর ভাষায় কথা বলছেন এবং পদক্ষেপ নেয়ার সময় অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
ইরানের পারমাণবিক জবাব দেয়ার কোনো ঝুঁকি আছে কি?
অথবা আদৌ ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা কি আছে? জোনাথন মার্কাস বলছেন, না। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নেই। যদিও দেশটির পারমাণবিক বিভিন্ন উপাদান রয়েছে; যার মাধ্যমে এ ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু পারমাণবিক সক্ষমতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
ইরান সবসময় জোর দিয়ে বলেছে যে, তারা বোমা চায় না। কিন্তু ওয়াশিংটনের কর্মকাণ্ডে ক্রমবর্ধমান হতাশা থেকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে তেহরানের পারমাণবিক যে চুক্তি রয়েছে; সেটি পরিত্যাগ করতে পারে ইরান। এটার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির পারমাণবিক চুক্তি থেকে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেছে। অনেক বিশ্লেষক ইরানের ওপর চাপপ্রয়োগের কথা বলছেন। কিন্তু কোনো ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া এমন পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হবে কিনা; সেটি আলোচনা সাপেক্ষ।
ইরাকে কি করেছে জেনারেল সোলেইমানি? এ ব্যাপারে ইরাকি সরকার কি বলছে?
ইরাকে এই সামরিক জেনারেলের কাজের বিষয়টি পরিষ্কার নয়। তবে ইরাকের বেশকিছু শিয়া মতাবলম্বী গোষ্ঠীর ওপর ইরানের সমর্থন রয়েছে। মার্কিন হামলায় জেনারেল সুলেইমানির সঙ্গে মারা গেছেন ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপ কাটাইব হেজবুল্লাহর নেতা আবু মাহদি আল-মুহান্দিস। সম্প্রতি ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলার জন্য এই গোষ্ঠীকে দায়ী করে ওয়াশিংটন।
এ হামলার পর সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছে ইরাকি সরকার। দেশটির সরকার উভয় দেশের (যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান) মিত্র। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরাক সরকারের অনুরোধে সেখানে সেনা মোতায়েন রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বিশদ পরিসরে সহায়তা করছে বাগদাদের ক্ষমতাসীন সরকার।
দেশের ভেতরে মার্কিন স্থাপনায় মিলিশিয়াদের সাম্প্রতিক হামলা নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ইরাক সরকার। মিলিশিয়াদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দাও জানিয়েছিল ইরাক সরকার। একই সঙ্গে তারা বলেছিল, ঘাঁটি রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র এই মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে আরও কঠিন পদক্ষেপ নেবে।
ইরাকের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কাসেম সোলেইমানি হত্যার ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করেছে। জেনারেল সোলেইমানি এবং মিলিশিয়া নেতা আবু মাহদি আল-মুহান্দিসকে শহীদ হিসেবে আখ্যা দিয়ে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের কৃতিত্বের কথা স্বীকার করেছে। ইরাকি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে; সেই চুক্তির শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে বলেও জানিয়েছে দেশটির সরকার।
ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের কাজ কি?
ইরাকের শিয়া নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সরকারে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরান। এছাড়া দেশটিতে মূল ক্রীড়ানকের ভূমিকাও পালন করছে তেহরান। ইরাকের বেশকিছু সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করছে ইরান। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৫ হাজার সৈন্য রয়েছে।
দেশটিতে আইএসকে পরাজিত করার লড়াইয়ে ইরাকি সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দিচ্ছে মার্কিন সৈন্যরা। মূলত, বাইরের এই দুই খেলোয়াড় ইরাকের ভেতরে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
সেরা নিউজ/আকিব