আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ দাবানল কি চিন্তার কারণ হতে যাচ্ছে? আমাদের বায়ুমণ্ডলেও কি তা প্রচুর পরিমাণে ভরে দিয়েছে ভয়ঙ্কর বিষের কণা ‘এরোসল্স’? বাতাসে ভাসমান এই সব ধূলিকণা (এরোসল্স) আমাদের শ্বাসের বাতাসকে তো আরও বিষিয়ে দেবেই, শ্বাসকষ্টজনিত নানা ধরনের রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই ভয়াবহ দাবানলের ফলে ভারতের বায়ুমণ্ডলে আরও বিষিয়ে ওঠার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যতটা এরোসল্স থাকলে তা মোটামুটি স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়, ভারতে ইতিমধ্যেই তার পরিমাণ ৩ থেকে ৪ গুণ। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।
আশঙ্কার কারণ নাসা ও আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ওশনিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নোয়া) উপগ্রহ সুয়োমি এনপিপির পাঠানো ছবি ও তথ্য। তাতে দেখা যাচ্ছে, ওই দাবানলের ধোঁয়া ইতিমধ্যেই গোটা বিশ্ব ঘিরে ফেলেছে। আর ঘিরে ফেলার পর তা এখন ফিরে গেছে আবার পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায়। আর তার জেরে প্রচুর পরিমাণে এরোসল্স জমা হয়েছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে।
দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (আইআইটি) সেন্টার ফর অ্যাটমস্ফেরিক সায়েন্সের অধ্যাপক সাগ্নিক দে বলছেন, অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ দাবানল সারা বিশ্বের জন্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। প্রায় একই রকমের ঘটনা ঘটেছিল ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯২ সালে ‘পিনাটুবো’ আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর। বায়ুমণ্ডল ভরে গিয়েছিল এরোসল্স কণায়। ওই ঘটনায় কয়েক মাসের জন্য পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে গিয়েছিল প্রায় অর্ধেক ডিগ্রি সেলসিয়াস। যাকে বলা হয়, ‘গ্লোবাল কুলিং’ বা ‘বিশ্ব হিমায়ন’। হ্যাঁ, এই উত্তরোত্তর উষ্ণায়নের সময়েও।
এ বারও এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্য, ওই ভয়াবহ দাবানলের ধোঁয়া যেহেতু ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে, আর তা ইতিমধ্যেই কার্যত পুরো বিশ্বকে ঘিরে ফেলেছে, তাই এই ঘটনার পরেও এরোসল্স কণার পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়ে সাময়িকভাবে বিশ্ব হিমায়ন ঘটাতে পারে।
কল-কারখানার দূষণ, আগুনের ধোঁয়া, ধূলোঝড়ের ধুলো, সামুদ্রিক লবণ, আগ্নেয়গিরির ছাই এবং ধোঁয়াশা থেকে এরোসল্স কণাদের জন্ম হয়। এরা কঠিন ও গ্যাসীয়, সাধারণত পদার্থের এই দুটি অবস্থায় থাকে। তবে গ্যাসীয় অবস্থায় থাকলেও পরে তা কঠিন অবস্থায় রূপান্তরিত হয়।
হাঁপানির মতো শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগে যারা ভোগেন, এরোসল্স কণা তাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক, বলছেন কলকাতার হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অচ্যুত সরকার।
সাগ্নিক বলছেন, এরোসল্স কণা জলবায়ুর উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে। তা যেমন উষ্ণায়নের কারণ হতে পারে, তেমনই তা কারণ হতে পারে হিমায়নেরও। এরা যেমন শুষে নিতে পারে এমনকি অতি শক্তিশালী অতিবেগুনি রশ্মিও, তেমনই সেগুলোর বিচ্ছুরণও ঘটাতে পারে।
বাড়তি উদ্বেগের কারণ, নাসা ও নোয়ার সুয়োমি এনপিপি উপগ্রহের পাঠানো ছবি ও তথ্য এও জানিয়েছে, সেই এরোসল্স কণারা আর বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে নিচের স্তরে (আমাদের সবচেয়ে কাছাকাছি বায়ুমণ্ডলে, যাকে ট্রপোস্ফিয়ার বলা হয়) নেই। তারা পৌঁছে গেছে বায়ুমণ্ডলের আরও উপরের স্তরে। যার নাম স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার।
সাগ্নিকের কথায়, এটাই আমাদের উদ্বেগ, আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের ধোঁয়া উঠে গেছে ট্রপোস্ফিয়ারের উপরের স্তরে। বিজ্ঞানের পরিভাষায়, বায়ুমণ্ডলের যে স্তরের নাম স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। ভূপৃষ্ঠ থেকে যার সর্বোচ্চ উচ্চতা হতে পারে ৬ থেকে ২০ কিলোমিটার। এমনকি, ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্তও বিস্তৃত হয়ে থাকতে পারে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। এই স্তরে থাকে বায়ুমণ্ডলের সব গ্যাসের মাত্র ১৯ শতাংশ। কিন্তু স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে জলীয় বাষ্পের কণা থাকে না বললেই চলে। এই স্তর সেই অর্থে কার্যত শুকনোই।
তিনি জানান, ট্রপোস্ফিয়ারে যত উপরে ওঠা যায়, ততই তাপমাত্রা কমতে থাকে। কিন্তু স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তুলনামূলকভাবে গড় তাপমাত্রা বাড়ে। ট্রপোস্ফিয়ারের মতো স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ঘনঘন রদবদলও ঘটে না। তাই সেখানে এরোসল্স কণারা পৌঁছলে সেখানে তা দীর্ঘ দিন থেকে যায়। যেটা ট্রপোস্ফিয়ারে হয় না। সেখানে জমা এরোসল্স কণা বৃষ্টির সঙ্গে ধুয়ে যায়।
তার ফলে, এরোসল্স কণারা যদি ক্রমশই স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের একটি স্তর থেকে তার উপরের স্তরে পৌঁছায়, তা হলে সেই কণারা নিশ্চিতভাবেই আরও বাড়িয়ে দেবে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা। তবে সেটা কতটা বিপজ্জনক হবে তা নির্ভর করছে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে কতটা উচ্চতা পর্যন্ত সেই এরোসল্স কণারা পৌঁছে গেছে, আর সেখানে এরোসল্স কণাদের স্তর কতটা পুরু, তার উপরেই।
সেরা নিউজ/আকিব