নিজস্ব প্রতিবেদক:
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে লজ্জা দিতে তাঁদের নাম দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। পাশাপাশি পত্রিকায়ও তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে। এ তালিকা প্রকাশের এক মাসের মধ্যে বন্ধকীকৃত সম্পত্তি দখল ও বিক্রির জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব ঋণখেলাপি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আর কোনো ঋণ পাবেন না। এঁরা যাতে উড়োজাহাজে দামি ক্লাসে ভ্রমণ করতে না পারেন সে জন্য তাঁদের তালিকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে তাঁদের ট্রেড লাইসেন্স, গাড়ি ও বাড়ি রেজিস্ট্রেশন এবং ব্যবসা নিবন্ধনে।
শুধু তা-ই নয়, খেলাপিদের ব্যাংকের যেসব পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং জেনারেল ম্যানেজার সুবিধা দেবেন তাঁদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ ধরনের কঠোর বিধান রেখে ব্যাংক কম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধন করছে সরকার। খসড়া আইনে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের যাতে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয় সে জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ বিধান।
খসড়া আইনের ২৭ কককক ধারা করা হয়েছে শুধু ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের নিয়ে। এতে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শনাক্ত করতে প্রতিটি ব্যাংকে কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি তালিকা আকারে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আবার সে তালিকা দেশে কার্যরত প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাঁদের নামের তালিকা নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেবে। পাশাপাশি সে তালিকা পত্রিকায় প্রকাশ করবে। এসব খেলাপিকে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর ঋণ বা আর্থিক সুবিধা দেবে না। যদি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো খেলাপিকে ঋণ দেয় আর তা যদি প্রমাণিত হয় তবে সেটি অবৈধ ও বাতিল বলে গণ্য হবে। ঋণের টাকা খেলাপিকে ফেরত দিতে হবে। ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করবে। যেসব পরিচালক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এই ঋণের সঙ্গে জড়িত তাঁদের পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হবে। পাশাপাশি তাঁদের ন্যূনতম তিন বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণ গ্রহীতাদের তালিকাভুক্তির এক মাসের মধ্যে বন্ধকীকৃত সম্পত্তি দখল ও বিক্রির জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করবে।
২৭কককক(৪) এ বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকায় ছিলেন বা আছেন এমন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না।
একই ধারার (৫) মোতাবেক স্বেচ্ছাকৃত/ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে পাঠিয়ে তাঁদের বিজনেস ক্লাসে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি ও বাড়ি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানি অ্যান্ড ফার্মসের কম্পানি নিবন্ধনের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া, অস্তিত্ববিহীন কম্পানির ঋণ, ঋণের অর্থের ভিন্ন খাতে ব্যবহার, পাচার, নিরীক্ষকদের ভূমিকা, তাঁদের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া ও শাত্তিমূলক ব্যবস্থা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুসরণীয় বিষয় ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট করে একটি বিশেষ সার্কুলার জারি করবে। এ ছাড়া খেলাপিদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বয়কট করতে সরকার রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সম্মাননা প্রদান ও অনুষ্ঠানের নীতিমালা করার সময় ঋণ খেলাপের বিষয়টি বিবেচনা করবে।
খসড়া আইনে আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংক থেকে অপসারিত ব্যক্তির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু তাই নয়, বিদ্যমান আইনে ‘জনস্বার্থে’ বাংলাদেশ কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীকে (এমডি) অপসারণ করতে পারে। কিন্তু ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী ছাড়াও আগামী দিনে ডিএমডি এবং জেনারেল ম্যানেজারকে অপসারণ করতে পারবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ক্ষমতা সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে কিছুটা খর্ব করা হয়েছে। খসড়া আইনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরকারি ব্যাংকের পরিচালক, এমডি, সিইও নিয়োগ, পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে না।
খসড়া আইনটিতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের পরিচালক, এমডি, ডিএমডি এবং জিএম দায়িত্ব লঙ্ঘন করলে এক কোটি টাকা জরিমানা এবং তিন বছরের জেল হবে। আইনের ৪৫(৭) ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক অপসারিত হলে তাঁর বা তাঁদের কারণে আর্থিক ক্ষতি হলে তা পূরণ করতে বাধ্য থাকবে। পরিচালক বা তাঁর পরিবারের নামে থাকা শেয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হবে। পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ, আদায়/নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ, সম্পত্তি জব্দ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। আর বিধি লঙ্ঘনকারীদের প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড বা অন্যূন তিন বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ব্যাংক কম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধনের খসড়ায় কারা পরিচালক হতে পারবেন না তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির নামে জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকলে বা কোনো তদন্ত সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে বিরূপ মন্তব্য করলেও তিনি পরিচালক হতে পারবেন না।
দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের বিষয়ে আইনটিতে নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে। আইনের ৫৮ক এর (১) মতে, যদি কোনো ব্যাংক মনে করে যে তার তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত হারে ও পন্থায় সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না, পাশাপাশি এর অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হবে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করবে। উপধারা (ঘ) এ বলা হয়েছে, জনস্বার্থে ও দেশের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই ব্যাংকের পুনর্গঠন বা ক্ষেত্রবিশেষে অবসায়ন করতে পারবে। এ ছাড়া ৫৮(খ) মোতাবেক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ করতে পারবে। ব্যাংকের দুর্বলতার জন্য দায়ীদের ক্ষেত্রে আইনে ফৌজদারি মামলা, অপসারণ এবং শেয়ার বাজেয়াপ্তের কথা বলা হয়েছে।
সেরা নিউজ/আকিব