নিজস্ব প্রতিবেদক:
কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কি প্যারোলে মুক্তি পাচ্ছেন? খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা তাকে বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করাতে চান। এ ক্ষেত্রে প্যারোলে হলেও খালেদা জিয়ার মুক্তি চান তারা। খালেদা জিয়ারও প্যারোলের বিষয়ে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন তারা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে– খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি কতটা সম্ভব? বিএনপি নেতারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই। তবে সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের বক্তব্যে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে কৌশলী অবস্থান ফুটে ওঠে।
যেমন শনিবার ময়মনসিংহের ভালুকায় এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি চেয়ে প্যারোলের আবেদন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে ‘আন্তরিক থাকবেন’। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া জেলখানায় আছেন, উনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সংবিধানের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান সুযোগ পাবেন, বেগম জিয়া যেহেতু একটি দলের প্রধান এবং উনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার ব্যাপারে রাষ্ট্র অত্যন্ত আন্তরিক।
এদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে বিএনপি রাজনীতি করছে অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন– খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো– তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়াই করে জামিন নিতে হবে। অন্যটি হলো– প্যারোলে মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। ওনারা সেটি (প্যারোল) করেননি। উল্টো তারা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে নোংরা রাজনীতি করে যাচ্ছেন।
খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির আবেদন নিয়ে সরকার যে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে, সেটি বোঝা যায়– আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের একটি বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার পরিবারের বরাত দিয়ে এক ধরনের কথা, আবার দলের পক্ষ থেকে আরেক ধরনের কথা বলা হচ্ছে। একদিকে আন্দোলনের ডাক, অন্যদিকে আমাদের সাধারণ সম্পাদককে ফোনে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ করে তারা আসলে কী চান– সেটি এখনও স্পষ্ট করতে পারেননি।
তিনি বলেন, প্যারোল হচ্ছে– খালেদা জিয়া অপরাধ ও শাস্তি মেনে নিয়ে মুক্তির আবেদন করবেন। এমতাবস্থায় বিএনপি প্যারোলে মুক্তির আবেদন করবে কিনা সেটিও একটি বড় প্রশ্ন।
বিএনপি নেতাদের বর্তমান অবস্থান হচ্ছে– তারা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আবারও আইনি প্রক্রিয়ায় হাঁটবেন। একই সঙ্গে কৌশলে রাজনৈতিকভাবে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। খালেদা জিয়ার পরিবার চাইলে প্যারোলে মুক্তির আবেদন এখনই করতে চাচ্ছে না বিএনপি।
এদিকে খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকেও এখনও পর্যন্ত প্যারোলে মুক্তির আবেদন করা হয়নি। এমনটি নিশ্চিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, খালেদা জিয়ার স্বজনরা চিকিৎসকদের কাছে আবেদন করেছেন৷ কিন্তু এ বিষয়ে চিকিৎসকরা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। তারা যদি প্যারোলে চান, তা হলে আদালতে আবেদন করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আবেদন করতে পারেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার টেবিলে এমন কোনো আবেদন নেই। এখন আবেদন না করলে অগ্রগতি তো বলা যাবে না।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। সেখানকার মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. জিলন মিয়া সরকার পাঁচ সদস্যের এই বোর্ডের প্রধান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্যের বরাত দিয়ে ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে, প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি মেডিকেল বোর্ড সুপারিশ করতে পারে না। খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের পর মেডিকেল এখন পর্যন্ত কোনো বৈঠক করেনি। মেডিকেল বোর্ড মনে করছে, বিএনপি নেত্রী স্বাস্থ্য স্থিতিশীল রয়েছে।
এমতাবস্থায় বিষয়টি স্পষ্ট যে, মেডিকেল বোর্ডের কাছ থেকে বিএনপি কিংবা খালেদা জিয়ার পরিবার প্যারোলের সুপারিশ পাবে না। বিষয়টি হয় রাজনৈতিকভাবে কিংবা আদালতের মাধ্যমে ফয়সালা করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন যে, প্যারোলের সুপারিশ করার এখতিয়ার মেডিকেল বোর্ডের নেই।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম স্পষ্টই বলে দিয়েছেন যে, খালেদা জিয়াকে মুক্তি পেতে হলে আদালতের মাধ্যমেই পেতে হবে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। শুক্রবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের জানান, বিএনপি মহাসচিব তাকে ফোন করে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করতে তাকে অনুরোধ করেছেন। তবে বিএনপি এ ক্ষেত্রে কোনো লিখিত চিঠি দেয়নি বলেও জানান তিনি।
বিএনপি আদালত থেকেই এ বিষয়ে ফয়সালা নিয়ে আসুক এমনটি ইঙ্গিত করে ওবায়দুল কাদেরের ভাষ্য– ‘তারা (বিএনপি) শুধু মুখে মুখেই মুক্তির কথা বলছেন, কিন্তু লিখিত কোনো আবেদন করেননি। এটি দুর্নীতির মামলা। রাজনৈতিক মামলা হলে সরকার বিবেচনা করতে পারত’-যোগ করেন কাদের।
ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি বারবার সরকারের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তি বা প্যারোলে মুক্তি চাচ্ছে, কিন্তু বিষয়টি রাজনৈতিক মামলা নয়। সরকার বিষয়টি তখনই বিবেচনা করতে পারত, যদি সেটি রাজনৈতিক হতো।
তিনি বলেন, তারা (বিএনপি) প্যারোলের জন্য আবেদন করলে কী কী কারণে প্যারোল চান তা আবেদনে উল্লেখ করতে হবে। সেটি নিয়মের মধ্যে পড়ে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে বিএনপি নেতারা রাজনীতি করছেন জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, মেডিকেল বোর্ড যে রিপোর্ট দেবে তা আদালতের কাছে পৌঁছাতে হবে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে নেতারা যেভাবে বলেন, দায়িত্বরত ডাক্তাররা সেভাবে বলেন না।
এদিকে খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন– তার স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। যে কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন৷ প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে পরিবারের আবেদন সম্পর্কে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার সাংবাদিকদের বলেন, তার দ্রুত অবনতিশীল স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনো অপূরণীয় ক্ষতি এড়াতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন৷ পরিবারের পক্ষ থেকে ব্যয়বহনসহ তাদের দায়িত্বে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে আবেদনে।
মঙ্গলবার খালেদা জিয়াকে দেখে এসে তার বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, মেডিকেল বোর্ড যেন বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারকে সুপারিশ করে, সে জন্য তাদের এ আবেদন। আবেদনে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে চেয়েছি। তিনি বলেন, প্যারোলে হলেও তারা খালেদা জিয়ার মুক্তি চান। এ ক্ষেত্রে (প্যারোল) খালেদা জিয়া আপত্তি করবে না বলেও জানান তিনি।
প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিএনপির মধ্যে আগে থেকেই মতবিরোধ রয়েছে৷ বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার কথাও বলে আসা হচ্ছিল দলটির পক্ষ থেকে৷ কিন্তু গত দুই বছরে তেমন কোনো জোরালো পরিস্থিতিও দলটি তৈরি করতে পারেনি৷
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এ বিষয়ে বলেন, আমি শুরু থেকেই বলে আসছি– আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি পেতে সময় লাগবে। তার যে স্বাস্থ্যের অবস্থা, তাতে দ্রুত তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। যদিও আমাদের দলের নেতারা শুরু থেকে প্যারোলের বিরোধিতা করে আসছেন। তারা মনে করছেন, প্যারোলে চাইলে আমাদের পরাজয় হবে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি ফের আইনি প্রক্রিয়ায় এগোবে জানিয়ে সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক এই সভাপতি বলেন, আমরা শিগগিরই আবার জামিন চাইব। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র না থাকলে ন্যায়বিচার পাওয়াও অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়৷ তাই প্যারোল বা জামিন দুটোই সরকারের হাতে। তারা চাইলে যে কোনোভাবে তাকে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে পারেন।
তবে প্যারোলের বিষয়টি উড়িয়ে দেননি তিনি। বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও ওয়ান ইলেভেনের সময় প্যারোলে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন৷ পাকিস্তানেও নওয়াজ শরিফ প্যারোলে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন৷ বিশ্বে এমন অনেক নজির আছে৷
গত ২০১৮ সালেরে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছর সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এরই মধ্যে তার কারাজীবনের দুই বছর কেটে গেছে। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়ায় গত বছরের ১ এপ্রিল তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ভর্তি করা হয়। এখনও তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন।
মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার ৬ স্বজন তাকে হাসপাতালে দেখে আসেন। বেরিয়ে এসে তারা জানান, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য তারা বিদেশ নিয়ে যেতে চান। এ জন্য প্যারোলে মুক্তি দিলে তাতে তাদের আপত্তি থাকবে না।
চিকিৎসাধীন থাকলেও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ‘গুরুতর’ বলে স্বজন ও বিএনপি নেতাদের ভাষ্য। ৭৪ বছর খালেদা জিয়া আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। তিনি এখন একা চলাচল করতে পারেন না, এমনকি সাহায্য ছাড়া খেতেও পারেন না বলে কয়েকদিন আগে তাকে হাসপাতালে দেখে এসে বোন সেলিমা ইসলাম জানিয়েছেন। তার বা হাতটা বেঁকে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আর ‘বেশি দিন পর’ খালেদাকে জীবিত বাড়ি ফিরিয়ে নিতে পারবেন না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গত মাসেই খালেদাকে দেখে এসে তার মুক্তির জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে ‘বিশেষ আবেদন’ করার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন সেলিমা ইসলাম। তবে গত সপ্তাহেই খালেদার সঙ্গে সাক্ষাতের দিনে স্বজনদের থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্যের বরাবর আবেদন করা হয়েছে, খালেদার মুক্তির বিষয়টি ‘মানবিক’ দিক থেকে বিবেচনার জন্য। আবেদনে প্যারোলের বিষয়ে কিছুই বলেননি তিনি।
এরপর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান নেত্রীর মুক্তির বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানালেও কীভাবে সেই যোগাযোগ তা খোলসা করেননি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুদিন আগে বলেছেন, খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ এটিই সত্য যেটি তার পরিবার তাকে দেখে এসেছে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় নিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান সরকারের কাছে জানান তিনি।
তবে সরকারের গুরুত্ব মন্ত্রীরা বলছেন, আদালতের রায়ে দণ্ডিত খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির বিষয়টি পুরোপুরি আদালতের এখতিয়ার। সেখানে সরকারের ‘কিছু করার নেই’। এমতাবস্থায় আইনি জটিলতা পেরিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি অদৌ সম্ভব কিনা সেটি নিয়ে সন্দিহান খোদ বিএনপি নেতারাই। এ কারণেই তারা প্যারোলে আবেদনের বিকল্প ভাবছেন।
সেরা নিউজ/আকিব