তথ্য প্রযুক্তি ডেস্ক:
বাংলা ভাষায় ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠার জন্য ডটবাংলা ডোমেইন ছিল বাঙালির জন্য স্বপ্ন। ওয়েব দুনিয়ায় বাংলার সগৌরব ঠিকানা খুঁজে নেওয়া। সেই ডটবাংলা ডোমেইনের অনুমোদন মিলেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনও হয়েছে তিন বছর আগে। কিন্তু সরেজমিনে অনুসন্ধানে এখনও কোনো ওয়েবসাইটকে চলতে দেখা যায়নি ডটবাংলার পথে। এমনকি যাদের এই ডোমেইন পরিচালনার কথা, সেই বিটিসিএলের ডটবাংলার ঠিকানায় থাকা ওয়েবসাইটে ক্লিক করলে সেটা কার্যকর হয় ডটকম বিডি ডোমেইনে। প্রশ্ন উঠেছে, কবে সক্রিয় হবে ডটবাংলা ডোমেইন?
এ ছাড়া জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, সংসদ সচিবালয় ও আইন বিভাগের যে সব সাইট ডটবাংলায় খোলা হয়েছিল সেগুলোও সক্রিয় নয়। এমনকি ঠিকানাঘরে (অ্যাড্রেস বার) ডটবাংলা লেখা কোনো সাইট অনুসন্ধান করতে গেলে কোনো ব্রাউজারই তা গ্রহণ করে না। অর্থাৎ ব্রাউজারের কাছে ডটবাংলা ডোমেইনের কোনো অস্তিত্বই নেই।
এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ডটবাংলা ডোমেইন সেবা দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ কোম্পানি বিটিসিএল সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এর ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ৮০০ টাকা। এরপরও ব্যবহারকারী হিসেবে কেউ এই ডোমেইনে ওয়েবসাইট চালু করতে না চাইলে সরকার, মন্ত্রণালয় কিংবা বিটিসিএল-এর কী করার আছে! কেউ বাংলায় ওয়েব ঠিকানা খুলতে না চাইলে জোর করে খোলা কি সম্ভব? তিনি বাংলা ভাষায় ওয়েব ঠিকানা তৈরি করে ওয়েবসাইট চালুর জন্য ব্যবহারকারীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ডটবাংলা ডোমেইন : কান্ট্রি কোড টপ-লেভেল- এই ডোমেইন হিসেবে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক ডোমেইন ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইন্ড নেইমস অ্যান্ড নাম্বারস (আইক্যান) ডটবাংলার ম্যানেজার হিসেবে বিটিসিএলকে অনুমোদন দেয় ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর। এরপর ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ডটবাংলা ডোমেইনের উদ্বোধন করেন।
ডটবাংলা ডোমেইনের বিশেষত্ব হচ্ছে এর ডোমেইনে সরাসরি বাংলায় ওয়েব ঠিকানা তৈরি করা সম্ভব। যেমন ‘জ্বালানি ও খনিজসম্পদ.বাংলা’, ‘বিটিসিএল.বাংলা’।
বিটিসিএল সূত্র জানায়, প্রত্যাশা ছিল সরকারি পর্যায়ে এই ডটবাংলা ডোমেইনের ব্যবহার ব্যাপক হবে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। এ জন্য বিটিসিএল ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিবকে চিঠি দিয়ে ডটবাংলা ডোমেইন সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-সংস্থাগুলোর অনাগ্রহের কথা জানায়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ডটবাংলা ডোমেইন ব্যবস্থাপনায় আধুনিক সুবিধা থাকার পরও এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনে অনাগ্রহ রয়েছে। চিঠিতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এই ডোমেইন বাস্তবায়নে প্রশাসনিক নির্দেশনা চাওয়া হয়।
এরপর ২০১৭ সালের ২৪ অক্টেবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসককে তাদের অধীন সব দপ্তর ও সংস্থাকে বিটিসিএলের ডটবিডি ও ডটবাংলা ডোমেইন বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন ও গতিশীল, সক্রিয় ওয়েবসাইট তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে মোস্তাফা জব্বার সব ডোমেইন এক ক্যাটাগরিভুক্ত করেন এবং ডোমেইনের দাম ২৫ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৮০০ টাকায় নামিয়ে আনেন। ডোমেইনের জন্য অনলাইনে আবেদন, বরাদ্দ ও মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করার উদ্যোগও নেন তিনি। তবে এত সব উদ্যোগের পরও ডটবাংলা ডোমেইন এখনও অন্ধকারে।
কেন এই করুণ অবস্থা : আইক্যান থেকে ডটবাংলা ডোমেইনের অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা ছিল। তবে ২০১৬ সালে বিডিনগের উদ্যোগে খ্যাতনামা তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির আইক্যানের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং শেষ পর্যন্ত বিটিসিএল অনুমোদন পায়।
সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ডটবাংলা ডোমেইন চলেনি দুটি কারণে। প্রথমত, এটির ঠিকানা বাংলায় হওয়াতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ছাড়া আর কেউ এর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন না। এমন ঠিকানাসম্পন্ন ওয়েবসাইটের আন্তর্জাতিক ব্যবহারের সুবিধা না থাকায় এ ক্ষেত্রে অনেকেই আগ্রহী নন। তবে বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ অনেক। তাই ডটবাংলা ডোমেইনের উল্লেখযোগ্য ব্যবহারের সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে উদ্বোধনের পর বিটিসিএল এই ডোমেইনের কোনো বিপণন করেনি বললেই চলে। দেশের মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা আছে, আবেগ আছে। যার কারণে অনেকে ডটবাংলায় ওয়েব ঠিকানা খুলতেন, যদি বিটিসিএল সেভাবে প্রচার করত।
সুমন আহমেদ সাবিরের মতে, দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে বিটিসিএল ডটবাংলার নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ কারিগরি বিষয়গুলো হালনাগাদ করছে না। এটা শুধু ডটবাংলার ক্ষেত্রে নয়, ডটবিডির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ডটবিডি ব্যবহার করে ইংরেজিতে ওয়েবসাইট খোলা যায়, যেটার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বিটিসিএল। কিন্তু এ দুটি ডোমেইনের ক্ষেত্রে বিটিসিএল এখন পর্যন্ত অধিকতর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সমৃদ্ধ প্রযুক্তি ‘ডিএনএসসেক’ ভার্সন চালু করেনি। অথচ নিরাপত্তাজনিত কারণে কোনো সাইটই ‘ডিএনএসসেক’ ভার্সন ছাড়া কোনো ডোমেইন কিনবে না। এ অবস্থায় শুধু দাম কমালেই ব্যবহারকারীরা আগ্রহী হবে না।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সাবির বলেন, চলতি সপ্তাহেই অস্ট্রেলিয়াতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর টপ লেভেল ডোমেইন ব্যবস্থাপনা নিয়ে সম্মেলন হয়েছে। সেখানে ডোমেইনের আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং আরও নিরাপদ পরিচালনার বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা উপস্থাপন ও আলোচনা হয়েছে। ভারত ও শ্রীলংকার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কোম্পানির প্রতিনিধিরাও এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। অথচ এ বৈঠকে বিটিসিএলের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। আইক্যান থেকে বার বার বলা হয়েছে, বিটিসিএল চাইলে ডটবাংলা এবং ডটবিডির উন্নততর ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কিন্তু বিটিসিএলকে এ ধরনের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতেও দেখা যায়নি।
এ প্র্রসঙ্গে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রফিকুল মতিন বলেন, তিনি নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন এবং বিটিসিএলের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যার ফলে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনার মান অনেক ভালো হয়েছে। এখন তিনি বিটিসিএলের ডোমেইন পরিচালনায় দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর দেবেন। তিনি আশা করেন, সবার সহযোগিতা পেলে টপ লেভেল ডোমেইন হিসেবে ডটবাংলা মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হবে।
সেরা নিউজ/আকিব