নিজস্ব প্রতিবেদক:
গ্রেফতারের পর নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়ার নানা অপকর্মের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বের হচ্ছে। জালটাকা, অর্থপাচার, মাদক ও অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার পাপিয়া এখন স্বামীসহ ১৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে হোটেল ওয়েস্টিনসহ বিভিন্ন স্থানে পাপিয়ার বিলাসবহুল জীবনের দৃশ্য ও ভিডিও।
সেসব ভিডিওতে পাপিয়ার হাতে উল্কি বা ট্যাটু আঁকা রয়েছে। এছাড়া পাপিয়ার ডান বাহুতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থাপনার ছবি ও বাঁ বাহুতে এক দেবীর ছবির উল্কি রয়েছে।
একই রকম উল্কি আঁকা রয়েছে তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী হাতে।
এসব উল্কিদের মধ্যে একটি হচ্ছে ইংরেজি শব্দে লেখা – ‘কেএমসি’। এই ট্যাটু পাপিয়া ও তার স্বামী ছাড়াও নরসিংদীর আরো কয়েকজন যুবক-যুবতীর হাতে রয়েছে।
এরা সবাই পাপিয়ারই সাঙ্গপাঙ্গ ও তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহযোগী বলে জানা গেছে।
এই ট্যাটু দিয়ে পাপিয়া নিজের দলকে আর সবার থেকে পৃথক করে রেখেছিলেন। নিজের অপরাধ জগতের একটি বাহিনী তৈরি করেছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া পাপিয়ার সেই ট্যাটু বা উল্কির মানে কি জানতে আগ্রহী হয়েছেন অনেকে? নরসিংদীর মানুষদের কাছে এই ট্যাটু খুবই পরিচিত। বিশেষকরে যারা রাজনীতিতে সক্রিয় তারা এ বিষয়ে অনেক কিছুই জানেন। এই ট্যাটু সম্বলিতদের ‘কেএমসি বাহিনী’ বলে ডাকা হয় নরসিংদীতে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পাপিয়া ও তার সঙ্গীদের হাতে আঁকা ট্যাটু কেএমসি এর বিস্তারিত রূপ হচ্ছে – খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি। এই ট্যাটুধারীরা ভারতের আজমীরের বিখ্যাত ও ইসলামি ব্যক্তিত্ব খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির ভক্ত বলে দাবি করেন। বাস্তবে কেএমসি বাহিনীর কর্মকাণ্ড মোটেই ধর্মীয় অনুশাসন মানা কোনো দল নয়। নরসিংদীতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে দাপিয়ে বেড়ানোই তাদের মূল কাজ।
আর এই ট্যাটু থাকায় তারা পাপিয়ার লোক বলে অনেকেই মুখ খুলত না। এ বিষয়ে নরসিংদী আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মী এক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই কেএমসি বাহিনী গড়ে তোলেন পাপিয়া। কেএমসি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কমপক্ষে ৩৫ জন। তাদের সবাইকে মাসিক বেতন দিতেন পাপিয়া। তাদের কাজ ছিল, পাপিয়া দম্পতি শহরে এলে তারা তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয়া, পাপিয়ার গাড়ির সামনে–পেছনে মোটরবাইক নিয়ে মহড়া দেয়া। পাপিয়ার বিভিন্ন ফরমায়েশ খাটা। নরসিংদীর ভাগদী ও ব্রাহ্মণদী এলাকার যুবকেরা মূলত কেএমসি বাহিনীর সদস্য বলে জানান তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় জানান, পাপিয়ার লক্ষ্য ছিল নরসিংদীর এমপি হওয়া। এজন্য এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য তিনি তার কেএমসি বাহিনী গড়েছিলেন। সেই বাহিনীর লোকজনরা মোটরসাইকেলের ধোঁয়া উড়িয়ে এলাকায় দাপট দেখাত। তাদের দিয়ে এলাকায় ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
এখন তারা কোথায় জানালে তিনি বলেন, পাপিয়া গ্রেপ্তারের পর সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন। এখন তাদের কাউকে আর এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। এদিকে রিমান্ডে পাপিয়া জানিয়েছেন, নরসিংদীর মহিলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটি বাগিয়ে নিতে ৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন তিনি। পাপিয়া ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগের নরসিংদী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। ২০১৪ সালে কমিটি গঠন করে পাপিয়া এই পদ দেন যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল।
শুধু সংগঠনটির নরসিংদী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকই নয়, জেলা এমপিও হতে চেয়েছিলেন তিনি। যার জন্য ১০ কোটি টাকা জলে ফেলেছিলেন পাপিয়া। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরসিংদী থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পাপিয়া। এ জন্য ১০ কোটি টাকা খরচও করেছিলেন তিনি। শুক্রবার রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী এ তথ্য প্রকাশ করেন বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পাপিয়ার স্বপ্ন ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া। সেজন্য কোনো চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি তিনি। যুবলীগের পদের মতো এ মনোনয়নের বেলায়ও বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করেন পাপিয়া। ঢাকা মহানগর যুব মহিলা লীগ, আওয়ামী লীগ, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও এমপির ধর্ণা ধরেছিলেন তিনি। এসব নেতাকে পাপিয়া অন্তত ১০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা নিয়েও মনোনয়ন বাণিজ্যে হেরে যায় দায়িত্ব নেয়া নেতাকর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাপিয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করার সাহসই পাননি তারা।’
মনোনয়ন না পেয়ে এবং ১০ কোটি টাকা হারিয়ে ক্ষুব্দ হন পাপিয়া। হতাশা আর ক্রোধে আগের চেয়ে বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শুরু করেন মন্ত্রী, এমপিদের ব্ল্যাকমেইল।
একের পর অপরাধ জগতে জড়িত হয়ে অন্ধকার জগতের সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠেন। রুশ তরুণী এনে তাদের দিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রলোভন দেখাতেন। এক পর্যায়ে তাদের ভিডিওচিত্র ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করতেন।
তার এসব কাজে পূর্ণ সহায়তা করে স্বামী সুমন ও তার গং।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘পাপিয়া ও তার স্বামীসহ আরো দুজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে তারা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অর্থপাচারের বেশকিছু তথ্য মিলেছে। অস্ত্র প্রদর্শন করে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের তথ্যও মিলেছে।’
সেরা নিউজ/আকিব