ইসলামিক ডেস্ক:
একজন ঈমানদারের দৃঢ় বিশ্বাস হলো, পৃথিবীর কোনো কিছু আল্লাহর হুকুম ছাড়া হয় না। পবিত্র কোরআনে এসেছে ‘…আল্লাহই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও হুকুমদাতা…।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৪)
অতএব সুস্থতা ও অসুস্থতা উভয়টি আল্লাহ তাআলার হুকুমেই হয়।
রাসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ইসলামে ব্যাধি সংক্রমণের কোনো বাস্তবতা নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৫৫৭)
তাই সব মুসলমানের মৌলিক আকিদা ও বিশ্বাস হবে, যেকোনো রোগ সরাসরি আল্লাহর হুকুমেই প্রকাশ পায়। তবে হ্যাঁ, পৃথিবী আসবাবের জগৎ তথা কারণ ও উপকরণ প্রকাশের ক্ষেত্র হলো পৃথিবী। তাই ইসলাম কারণ ও উপকরণের স্বীকৃতি দিয়েছে। যেমন হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কুষ্ঠরোগী থেকে এমনভাবে পলায়ন করো, যেমন তুমি বাঘ থেকে পলায়ন করে থাকো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৭৬৭)
এতে বোঝা গেল, সংক্রমণটাও আল্লাহর হুকুমে হয়। রোগের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই।
এ আলোচনার মাধ্যমে এটাও পরিষ্কার হয়ে গেল যে ইসলাম সংক্রমণের অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি, তবে একে চূড়ান্ত ক্ষমতাধর জ্ঞান করতে নিষেধ করেছে। হজরত আলী (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস বর্ণনা করেন, ‘তোমরা কুষ্ঠরোগীদের বারবার দেখতে যেয়ো না, আর তাদের সঙ্গে যখন কথা বলবে তখন তাদের এবং তোমাদের মাঝখানে একটি বর্শার পরিমাণ দূরত্ব থাকা উচিত। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৫৮১)
সাকিফ গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল রাসুল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়। তাদের মধ্যে একজন কুষ্ঠরোগী ছিল। সে রাসুল (সা.)-এর হাতে হাত দিয়ে বাইআত হতে চেয়েছিল। রাসুল (সা.) তার হাতে হাত না মিলিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাকে (স্পর্শ না করেই) বাইআত করালাম, অতএব তুমি চলে যাও।’ (সহিহ মুসলিম, হদিস : ২২৩১)
হাদিস শরিফে প্লেগ সম্পর্কিত বর্ণনায় এসেছে, ‘যদি কোনো স্থানে প্লেগ প্রকাশ পাওয়ার কথা শোনো, তখন তথায় প্রবেশ কোরো না। আর যদি তোমাদের বসবাসের এলাকায় প্লেগ দেখা দেয়, তখন সেখান থেকে পালিয়ে যেয়ো না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭২৭-৫৭২৮)
এতে বোঝা যায়, রাসুল (সা.) প্লেগ-বিদূষিত এলাকায় এ জন্য যেতে নিষেধ করেছেন যে সেখানে গেলে প্লেগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। যেহেতু পৃথিবী আসবাবের জগৎ। আর যারা আগে থেকেই প্লেগ-বিদূষিত এলাকায় আছে, তাদের সেখান থেকে বের হতে এ জন্য নিষেধ করেছেন, যেন সুস্থ ব্যক্তিরা রোগীদের সেবা করতে পারে। আবার সে যদি নিজের সঙ্গে রোগের জীবাণুগুলো নিয়ে অন্য এলাকায় যায়, তবে সেখানেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। অতএব, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ মহল যেসব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে, তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বাস্তবায়ন করা জরুরি। যদি কোনো ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত হয়, সমাজের অন্য লোকদের দায়িত্ব হলো তার চিকিৎসা ও সুস্থতার জন্য যথাযথ চেষ্টা করা। আর রোগীর দায়িত্ব হলো, এমন কাজ থেকে বিরত থাকা, যার দ্বারা অন্য ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। তবে এই পরিমাণ সতর্কতা নয়, যার দ্বারা শরিয়তের জরুরি আমল বর্জিত হয়। সুতরাং করোনাভাইরাসের কারণ দেখিয়ে ব্যাপকভাবে মসজিদে জুমা এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে নিষেধ করা যাবে না।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। বিষয়টি হলো, একটি হাদিসে অতিবৃষ্টির সময় ঘরে নামাজ পড়ার কথা বলা হয়েছে। এটার সঙ্গে করোনাভাইরাসকে তুলনা করা যাবে না। কারণ, বৃষ্টি একটি নিশ্চিত বিষয়, আর কারোনাভাইরাসে সংক্রমণ অনিশ্চিত ও সন্দেহযুক্ত বিষয়। বেশি মানুষ একত্রিত হলেই যে ভাইরাস সবাইকে আক্রান্ত করবে, এটা আবশ্যক নয়। বরং আল্লাহ তাআলার হুকুম হলেই ভাইরাসাক্রান্ত হবে। যেমন—দেশের নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাহিনীর বিরাটসংখ্যক লোক সমগ্র পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত। শুধু লোক সমাগমই যদি ভাইরাস সংক্রমণের কারণ হতো, তাহলে এদের কেউ ভাইরাসমুক্ত হতে পারত না। তাহলে এই কারণ দেখিয়ে মসজিদে গিয়ে অল্প সময়ে নামাজ আদায় করতে কেন ব্যাপকভাবে নিষেধ করা হবে? সুতরাং করোনাভাইরাসসহ অন্য রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা বিশেষত জ্বর, সর্দি ও কাশির রোগীদের ক্ষেত্রে ঘরেই নামাজ আদায় করার পরামর্শ থাকবে। আর সুস্থ ব্যক্তিরা স্বীয় অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক অল্প সময়ে মসজিদে নামাজ পড়বে, তবে অজু ও ফরজ নামাজের আগের-পরের সুন্নাতগুলো ঘরেই আদায় করবে। যেহেতু অজুও একটা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, তাই অজুর সব আহকাম শরিয়তনির্দেশিত পদ্ধতিতে খুবই গুরুত্ব সহকারে আদায় করবে। জীবাণু দূরীকরণে অজুর সঙ্গে সাবান, হ্যান্ডওয়াশ ইত্যাদি ব্যবহারেরও পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।
জুমার নামাজে ইমামরা বয়ান, খুতবা, নামাজ ও মোনাজাত খুবই সংক্ষিপ্ত করবেন। সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা করতে হবে এবং মুসল্লিদের মসজিদে আসার সময় ‘মাস্ক’ ব্যবহার করতে নির্দেশ করা হবে। কিন্তু একেবারে জামাত বন্ধ করে দেওয়া কোনো চিকিৎসা নয়; বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক রোগ ও বিশ্বাসের দুর্বলতা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালিম আর কেউ নেই, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে আল্লাহর জিকির আদায় করতে নিষেধ করে এবং মসজিদগুলোকে অনাবাদ করতে চেষ্টা করে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১১৪)
ইতিহাস থেকে প্রমাণিত, হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে প্লেগ দ্বারা একটি এলাকার তিন-চতুর্থাংশ লোক মৃত্যুবরণ করে, আর আনাস (রা.)-এর ৮৩ জন সন্তান প্লেগ-আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে; কিন্তু তখনো কোনো মসজিদ বন্ধ করা হয়নি। সুতরাং রোগীরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঘরে পড়বে, আর জুমার দিনও মসজিদে না এসে ঘরে জোহরের নামাজ আদায় করবে। তবে ভাইরাস ও ভাইরাস-আক্রান্ত রোগীদের অজুহাতে ঢালাওভাবে সবার জন্য জামাত বন্ধ করা যাবে না। ইসলামী শরিয়তে জামাতের গুরুত্ব এতই বেশি যে যুদ্ধ চলাকালীন কঠিন মুহূর্তেও জামাত আদায়ের তাগিদ দেওয়া হয়েছে এবং তার নির্দিষ্ট পদ্ধতিও বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে একাধিক আয়াত নাজিল হয়েছে।
আর হ্যাঁ, করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য আসল পন্থা হলো আল্লাহ পাকের দরবারে তাওবা করা এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আপনি [রাসুল (সা.)] যত দিন তাদের মাঝে অবস্থান করবেন, তত দিন আল্লাহ তাআলা তাদের শাস্তি দেবেন না। অনুরূপভাবে তারা যত দিন ইস্তেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে তত দিন আল্লাহ তাদের ওপর আজাব নাজিল করবেন না।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৩৩)
করোনাভাইরাসের মতো সংকটকালীন জরুরি দোয়া ও আমল
১. রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অনুসরণে রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে সবাই সালাতুল হাজাত আদায় করবে। এটা অত্যন্ত উপকারী ও পরীক্ষিত আমল।
নিম্নোক্ত দোয়াগুলো বেশি বেশি পাঠ করবে।
২. উচ্চারণ : ‘রাব্বিগ ফিরলি ওয়ার হামনি।’
অর্থ : হে আল্লাহ, আমাকে মাফ করে দিন এবং আমার ওপর অনুগ্রহ করুন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৮৯৪)
৩. উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুজামি, ওয়ামিন সাইয়্যিইল আসকাম।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত, উন্মাদনা, কুষ্ঠ এবং সব দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৫৪)
৪. উচ্চারণ : বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইয়ুন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামায়ি ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম।
অর্থ : আল্লাহর নামে, যাঁর নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো কিছুই কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তিনি সব কিছু শোনেন এবং সব কিছু জানেন।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, এই দোয়া সকালে পাঠ করলে সারা দিন নিরাপদে থাকবে আর বিকেলে পাঠ করলে সারা রাত্রি নিরাপদে থাকবে। (আবু দাউদ হাদিস : ৫০৮৬)
৫. আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে। রাসুল (সা.) সব বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সাহাবায়ে কেরামকে আয়াতুল কুরসি তিলাওয়াত করার তাগিদ দিয়েছেন। এটি পাঠ করে নিজের শরীরে ও বাচ্চাদের শরীরে দম করবে (ফুঁ দেবে)।
৬. সকাল-বিকেল সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করবে। সুরা ফাতিহার অন্য নাম দোয়ার সুরা ও শিফার সুরা।
৭. সকাল-বিকেল সুরা ফালাক ও সুরা নাস পাঠ করে নিজের শরীরে ও বাচ্চাদের শরীরে দম করবে (ফুঁ দেবে)।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে করোনা নামক এই মহামারি ভাইরাস থেকে হেফাজত করুন এবং ভাইরাসাক্রান্ত সবাইকে এই রোগ থেকে মুক্ত করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের উপযোগী করে দিন।
লেখক : মহাপরিচালক, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
সেরা নিউজ/আকিব