ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক:
লন্ডনের কাছে কেন্ট কাউন্টির একটি আবাসিক এলাকায় ২৮ বছর ধরে চলছে বাংলাদেশি কারি রেস্তোরাঁ- মোগল ডাইনাস্টি।
করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর ক্রেতা সংখ্যা দ্রুত এত কমতে থাকে যে সরকারি নির্দেশনার আগে থেকেই তাকে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিতে হয়। গত ছয় সপ্তাহে অন্তত ৩০০ বাংলাদেশি কারি রেস্টুরেন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
যুক্তরাজ্য জুড়ে বাংলাদেশিদের রেস্তোরাঁ ব্যবসার বর্তমান চিত্র নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।
ব্রিটেনে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিঠু চৌধুরীর বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, এখন অনলাইন এবং টেলিফোনে খাবারের অর্ডার নিয়ে মানুষের বাসায় খাবার পৌঁছে দিয়ে রেস্তোরাঁটি চালু রাখার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।
ব্রিটেনে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিঠু চৌধুরী বলেন, আমার ৩৪ বছরের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় এমন সংকট আমি আগে কখনো দেখিনি। বিক্রি কমে গেছে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ। তার ১৬ জন কর্মীর মধ্যে সাতজন নিয়ে কাজ করছেন। বাকি নয়জন বাড়িতে বসে আছেন।
“আমি আগেও এদেশে দুবার মন্দা দেখেছি। প্রথম ১৯৮৯ সালে, পরে ২০০৮ সালে। এমন পরিস্থিতি আমি কখনো দেখিনি। কীভাবে টিকে থাকবো আমরা কেউই বুঝতে পারছি না।“
মিঠু চৌধুরী বলছেন, যে ‘মহামন্দা‘ আসছে তাতে রেস্তোরাঁ খোলার পরও ব্যবসা কমতে বাধ্য। “আমি ধরেই নিয়েছি আমাকে অন্তত ২৫ শতাংশ স্টাফ ছাঁটাই করতে হবে।“
তালাবন্ধ শুরু হয়ে গেছে
“সদস্যদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে আমাদের বলেছেন, ব্যবসা বন্ধ রেখে ভাড়া গোনা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে দরজায় তালা ঝুলিয়ে ভবন মালিকের হাতে চাবি দিয়ে এসেছেন।“
কমবেশি এমন চিত্র এখন ব্রিটেন জুড়ে শতশত বাংলাদেশি মালিকানাধীন কারি রেস্তোরাঁয়।
রেস্তোরাঁ মালিক এবং কর্মচারীদের কথা
লন্ডনের ব্রিক লেন এলাকাটি ব্রিটেনের কারি ক্যাপটাল নামে পরিচিত। সারি সারি বাংলাদেশি খাবারের রেস্তোরাঁর প্রায় সবগুলোতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তালা। দুই-একটি গত কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যায় অনলাইন হোম ডেলিভারি সার্ভিস শুরু করেছে।
ব্রিক লেনের স্বনামধন্য বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ সিটি স্পাইসের মালিক আব্দুল আহাদ জানান, তার ১২০ সিটের রেস্তোরাঁ টানা আট সপ্তাহ ধরে বন্ধ। তার মতই তার ১২ জন কর্মীর সবাই ঘরে বসে।
“একটি ব্যবসা দাঁড় করাতে একটি জীবন পার হয়ে যায়। সেই ব্যবসার এমন অবস্থা সহ্য করা কঠিন। সহসা যদি রেস্তোরাঁ খোলা সম্ভবও হয়, তাহলে যে ক্ষতি হচ্ছে তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর লাগবে।“
রেস্তোরাঁ খুললেও ব্যবসা আর আগের মত চলবে কিনা তা নিয়ে গভীর সন্দেহ রয়েছে আব্দুল আহাদের।
“বিশেষ করে আমার ৮০ শতাংশ কাস্টমার বিদেশি পর্যটক এবং লন্ডনে ব্যবসার সূত্রে আসা লোকজন। কতদিনে পর্যটকরা ফিরবেন আর সিটি (লন্ডনের ব্যবসা কেন্দ্র) কতদিনে চাঙ্গা হবে বলা খুবই মুশকিল। সুতরাং রেস্টুরেস্ট খুললেও আমি হয়ত সেই কাস্টমার পাবো না।“
মালিকদের আরেকটি আশঙ্কা হচ্ছে – এক-দেড় মাসের মধ্যে রেস্তোরাঁ খুলতে পারলেও সামাজিক দূরত্বের শর্তের কারণে কতজন কাস্টমার তারা ঢোকাতে পারবেন তা নিয়ে।
আব্দুল আহাদ মনে করছেন, ১২০ সিটের জায়গায় বড়জোর ৫০ থেকে ৬০ কাস্টমার ঢোকানো যাবে।
“তাহলে ব্যবসা কী তখন লাভজনক হবে. আমি কি আমার ১২ জন স্টাফকে তখন রাখতে পারবো?“
রেস্তোরাঁ মালিক এমজি মাওলা বলছেন – ‘’বার্মিংহাম এবং আশপাশের এলাকায় তার এই ‘টপ-এন্ড‘ রেস্তেরাঁ খুবই পরিচিত। একাধিকবার তিনি ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিকদের হরদম আনাগোনা এই রেস্তোরাঁয়। ২০ বছর ধরে মিশিলিনের তালিকায় ছিল রাজনগর।”
“এই ৩৩ বছরে কখনো টেক-অ্যাওয়ের কথা ভাবিনি। ব্র্যান্ড নষ্ট করতে চাইনি। কিন্তু এখন কী করবো? স্টাফরা বারবার ফোন করে যে তারা এখন কী করবে। কী খাবে?”
বিশ জন স্টাফের ১০ জনকে নিয়ে এখন টেক-অ্যাওয়ে সার্ভিস শুরু করেছে রাজনগর। কিন্তু বার্মিংহাম শহরের কেন্দ্রে, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের কাছে তার বারাজি নামে যে আরেকটি রেস্তোরাঁ রয়েছে সেটি পুরোপুরি বন্ধ।
ওই রেস্তোরাঁর ম্যানেজার আব্দুস শহিদ বলছেন, তাদের এখানে আসেন পর্যটক আর করপোরেট কাস্টমার। শহর এখন ভূতুড়ে। পর্যটক নেই। কনফারেন্স নেই। পাশের হোটেলগুলো খালি। এখানে টেকঅ্যাওয়ে খুললেও চলবে না।
তিনি এবং বারাজির আরো ২০ জন কর্মী ঘরে বসে। সরকার বেতনের ৮০ শতাংশ দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার ওপর ভরসা করেই উদ্বেগের মধ্যে তাদের জীবন কাটাতে হচ্ছে।
গোলাম মওলা বলছেন, রেস্তোরাঁ খুলে দেওয়ার পরও তা চলবে কিনা তা নির্ভর করছে সরকার যে সব সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা হাতে আসে কিনা তার ওপর।
“আমার দুটো রেস্টেুরেন্টই সবসময় লাভজনক। দুটো ব্যাংকের কাছে লোন চেয়েছিলাম। একটি দিয়েছে, অন্যটি প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি তো স্টাফের বেতন কমাতে পারবো না? ভাড়া বছরে ৮০,০০০ পাউন্ড, তা কি কমবে? ট্যাক্স কি কমবে? যে কাস্টমার আগে পেতাম তারা কি সবাই আসবেন?“
যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী এনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, যুক্তরাজ্যে ৭ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেস্তোরাঁ রয়েছে। গত ২০ মার্চ থেকে সরকারের নির্দেশ মেনে ডাইন ইন সার্ভিস (ভেতরের খাবার বন্ধ রেখেছে), তবে অধিকাংশেরই টেক এওয়ে সার্ভিস অব্যাহত রেখেছে ( কাস্টমার খাবার সংগ্রহ অথবা ঘরে সরবরাহ ব্যবস্থা ) তারা আংশিকভাবে সীমিত সংখ্যক লোকবল নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, নির্ধারিত কাউন্সিল ট্যাক্স যারা পরিশোধ করেছেন ইতিমধ্যে ১০ থেকে ২৫ হাজার পাউন্ড অনুদান পাচ্ছেন। যাদের কাজের সুযোগ নেই তারাও বেতনের ৮০ ভাগ অনুর্ধ্ব ২৫০০ পাউন্ড প্রত্যেক মাসে পেতে থাকবেন জুন মাস পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, সরকার শতভাগ নিশ্চিত ব্যাংক লোনের ঘোষণা দিয়েছে যা ১ বছর সুদবিহীন। মনে করা হচ্ছে সরকারের আন্তরিক কল্যাণমূলক এবং অর্থনীতি উদ্ধারে যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে অধিকাংশই ব্যবসা অন্তত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
সেরা নিউজ/আকিব