অনলাইন ডেস্ক:
বছরের পর বছর ইরাকে কাজ করে বাংলাদেশে অর্থ পাঠান রাজিব শেখ। কিন্তু এখন তার বেতন নেই। নিজেই চলতে পারছেন না। ধারও করতে পারছেন না। কারণ, সবারই এক অবস্থা। তাই রাজিব শেখ দেশে তার পরিবারের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। সাহায্য চাওয়া মানে টাকা পয়সা চাওয়া। পেস্ট্রি, কেক বানানোর শেফ তিনি।
বয়স ২৬ বছর। তিন মাস ধরে বেতন পান না। তাকে খাবার হিসেবে যে অর্থ দিতো নিয়োগকারীরা তাও তারা বন্ধ করে দিয়েছে। ইরাকে কর্মরত হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিকের অবস্থা এই একই রকম। বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তার মতে, এরই মধ্যে কাজ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২০ হাজার বাংলাদেশি। তাদের কোনোই উপার্জন নেই। পারছেন না দেশেও ফিরে যাওয়ার কোনো উপায়। তারা শুধু তাদের চারপাশে অর্থনীতিকে ধ্বংস হতে দেখছেন। এ খবর দিয়েছে অনলাইন মিডল ইস্ট আই।
রাজিব শেখ সাত বছর আগে তেলসমৃদ্ধ বসরা প্রদেশে গিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা তো দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতাম। কিন্তু এখন আমার এক কাজিনের কাছে টাকা চেয়েছি। বলেছি, আমার কাছে টাকা পাঠাতে। এখানে আমরা হয়তো আর কাজ ফিরে পাবো না। ফলে ইরাকে শুধু যে আমরা না খেয়ে আছি তা-ই নয়। দেশে আমাদের পরিবারেরও একই অবস্থা।
করোনাভাইরাসের কারণে নাটকীয়ভাবে পতন হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির। ওপেকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অশোধিত তেল উত্তোলনকারী ইরাকের অর্থনীতিতেও সেই আঘাত লেগেছে। পতন ঘটেছে তেলের দামে। ফলে তেল উত্তোলন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এ মাসের শুরুতে তেলের দাম নিয়ে ধ্বংসাত্মক এক লড়াইয়ে মেতে ওঠে সৌদি আরব ও রাশিয়া। তার ফলে ইরাক ও ওপেকের অন্যদেরকে তেল উত্তোলন কমিয়ে আনতে বাধ্য হতে হয়। সিদ্ধান্ত আছে যে, ইরাক সহ যেসব দেশ মে ও জুনে তাদের কোটার চেয়ে বেশি তেল উত্তোলন করেছে তাদেরকে জুলাই ও সেপ্টেম্বরে অতিরিক্ত কম তেল উত্তোলন করতে হবে। এর ফলে কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর্থিক সংকটে ইরাক। বিশ্বব্যাংক ধারণা দিয়েছে, এর ফলে ইরাকের জাতীয় প্রবৃদ্ধি শতকরা ১০ ভাগ কমে যাবে। এতে অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের গভীর দারিদ্র্যে নিপতিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।
রাজধানী বাগদাদে দর্জির কাজ করেন ৩২ বছর বয়সী পাকিস্তানি নাফিস আব্বাস। পুরো লকডাউনের চার মাস পরে তিনি গত সপ্তাহে কাজে ফিরেছেন। তিনি বলেন, আমি দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু ফেরার মতো অর্থ নেই আমার কাছে। এখন যদি পাকিস্তানে ফিরতে চাই তাহলে প্রয়োজন ৭০০ ডলার। কিন্তু আমার তো সেই অর্থ নেই। এমনকি আমার কাছে এক হাজার ইরাকি দিনারও নেই, যার মূল্য এক ডলারেরও কম।
তেলক্ষেত্রে থেকে শুরু করে রেস্তরাঁ- সবক্ষেত্রে নানারকম কাজ করতে গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ শ্রমিক গিয়েছেন ইরাকে। বাগদাদে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল কবিরের মতে, এর মধ্যে রয়েছে নিবন্ধিত আড়াই লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক। তিনি বার্তা সংস্থা এএফপি’কে বলেছেন, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। তবে অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকের হিসাব করা হলে এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। কাজ হারানো শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছেন বসরায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো এবং কন্ট্রাক্টরসে নিয়োজিত ৯ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক। এক সময় তারা এ খাতে কাজ করাকে সৌভাগ্যের বলে মনে করতেন।
রেজাউল কবির বলেন, তেলের দামের পতন হওয়ার কারণে প্রচুর তেলক্ষেত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে অনেকে শেষ দিনগুলোর বেতন দেয় নি। তেলক্ষেত্রে কর্মরত অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক ছুটে গেছেন উত্তরে রাজধানী বাগদাদের দিকে। তাদের আশা বাংলাদেশ দূতাবাস তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠাবে। রেজাউল কবির আরো বলেন, এসব মানুষের একটি তালিকা করা হচ্ছে। তাদের জন্য কোনো স্থান সংকুলান করতে পারার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের তালিকা করছি এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠাতে আমাদের সর্বোত্তম চেষ্টা করছি। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল। তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠাতে অনেক ফ্লাইট প্রয়োজন।
অভিবাসন বিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) এক জরিপ অনুযায়ী, কোভিড-১৯ এর কারণে ইরাকের শতকরা ৯৫ ভাগ কাজ বন্ধ হয়ে আছে। প্রতি ১০ জনের মধ্যে চারজন বলেছেন, অনেক শ্রমিককে ছাঁটাই দেয়া হয়েছে। অনেকে মনে করছেন এই সংকট আরো চার মাস স্থায়ী হবে।
ইরাকে একটি রেস্তরাঁর মালিক সালিম আহমেদ। তার অধীনে কাজ করেন বাংলাদেশি, মিশরীয় ও ইরাকি কর্মীরা। তিনি বলেছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে তার ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি মাসে এই লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার ডলার। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের কোনোই সাহায্য করছে না সরকার। তার ওপর জুলাইয়ের মধ্যে আয়কর দিতে হবে আমাদের।
লকডাউন পুরোপুরি তুলে নেয়া হলেও বহু ব্যবসায়ী মালিক বলেছেন, তারা তাদের কর্মকাণ্ড অথবা বিক্রি করোনা-পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। আইএলওর এক জরিপে শতকরা ৪০ ভাগ ব্যবসায়ী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাদের ব্যবসা অস্থায়ীভাবে বা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আইএলওর ইরাক সমন্বয়ক মাহা কাত্তা বলেছেন, এ জন্য এসব উদ্যোক্তাদের আর্থিক সাহায্য করার সব পথ খোলা রাখা উচিত সরকারের। তাদের উচিত সব শ্রমিককে জরুরি সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া, বিশেষ করে যারা অনানুষ্ঠানিক শ্রমিক তাদের জন্য এটা বেশি প্রয়োজন।
কিন্তু কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না ৪৯ বছর বয়সী বাংলাদেশি শ্রমিক মোহাম্মদ ফাদিল। ছোটখাটো কাজ করে তিনি দিন কাটাতেন বাগদাদে। তাতে নিজে চলতেন খুব কষ্টে। তবু কেটে যেতো দিন। কিন্তু এ বছর তার কাছে সবকিছু অনেক কঠিন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সবকিছু এখন বন্ধ। করোনাভাইরাসের কারণে কোনো কাস্টমার নেই। এতে আমাদের জীবন বাঁচানো আরো কঠিন হয়ে পড়েছে।
সেরা নিউজ/আকিব