নিজস্ব প্রতিবেদক:
বর্তমানে দেশের সবচেয়ে আলোচিত নামটি হলো সাহেদ করিম ওরফে মোহাম্মদ সাহেদ। নিজ প্রতারণার গুণে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিটিও তিনি। করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে ‘অবিশ্বাস্য প্রতারণায়’ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। নামের সঙ্গে ‘প্রতারকের তকমা’ নিয়ে গত কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়েই ছিলেন। এরপরও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত আটকা পড়তে হয় র্যাবের জালে। রিজেন্ট গ্রুপ ও হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম নিজেকে সুধী ও ক্লিন ইমেজের (পরিচ্ছন্ন) ব্যক্তি হিসেবে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু ও পাষণ্ড প্রকৃতির লোক। অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে তার কাছে মানুষের জীবন-মৃত্যুর কোনো মূল্যই নেই।
বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) সকালে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয় সাহেদকে। এ সময় সাহেদ ও মাসুদ পারভেজকে নিয়ে বিশেষ অভিযান পরিচালনা ও মামলার মূল রহস্য উদঘাটনসহ সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক এস এম গাফফারুল আলম। প্রতিবেদনটিতে তিনি এসব কথা উল্লেখ করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আসামি সাহেদ ও মাসুদ পারভেজ প্রতারণা চক্রের প্রধান হোতা। ৬ জুলাই র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমসহ র্যাব সদস্যরা উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে করোনার ১০টি ভুয়া এবং জাল পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়ে তা জব্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেন, এই স্ক্যানকৃত ভুয়া এবং জাল রিপোর্টগুলো রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের নির্দেশনায় ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় উত্তরা পশ্চিম থানাধীন (NISORGo ROSe) হেড অফিসে তৈরি করা হয়।
গ্রেফতারকৃত সাহেদ (৪৫), মাসুদ পারভেজ (৪০), তরিকুল ইসলাম (৩৩), আব্দুর রশিদ খান জুয়েল (২৯), শিমুল পারভেজ (২৫), দীপায়ন বসু (৩২), মাহবুব (৩৩), সৈকত (২৯) ও পলাশ (২৮) জাল জালিয়াতির মাধ্যমে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট প্রস্তুত ও সরবরাহ করে আসছিলেন।
ডিবির প্রাথমিক অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে আসে, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ নিজেকে সুধী ও ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি হিসেবে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু ও পাষণ্ড প্রকৃতির লোক। অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রশ্নে তার কাছে মানুষের জীবন-মৃত্যুর কোনো মূল্যই নেই। সে তার সহযোগীদের সহায়তায় প্রতারণার মাধ্যমে কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। কোনো রোগী যদি প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করতেন, তাহলে সাহেদ তাদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিতেন।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, তার হুমকির ফলে আর কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষার ফর্মে এ পরীক্ষা বিনামূল্যে করার কথা উল্লেখ থাকলেও প্রতিটি রোগীর কাছ থেকে ৩৫০০-৪০০০ টাকা নেয়া হতো। এছাড়া চিকিৎসা প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি ও ভুয়া রিপোর্ট দেয়াসহ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩-৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাহেদ। যা মানিলন্ডারিং আইনের পর্যায়ভুক্ত।
সাহেদ-মাসুদের ১০ দিনের রিমান্ড, তরিকুলের ৭-
এসব জাল-জালিয়াতির দায়ে করা মামলায় গ্রেফতার রিজেন্টের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম এবং প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজকে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। আর সাহেদের প্রধান সহযোগী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীর দ্বিতীয় দফায় সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) তাদের তিনজনকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তিনজনের ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক এস এম গাফফার আলম। অপরদিকে, তাদের আইনজীবী নাজমুল হোসেন রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে সাহেদ ও মাসুদের ১০ দিনের এবং তরিকুলের সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর হাকিম মো. জসিম।
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু শুনানিতে বলেন, ‘সাহেদ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। সে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন। সে দেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তার সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে কি না, তা বের করার জন্য রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন। তাই তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রার্থিত ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করছেন আদালত।’
সাহেদের আইনজীবী নাজমুল বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ ও জালিয়াতির কথা বলেছে। আমরা তার পক্ষে জামিন আবেদন করেছিলাম। আমরা আদালতকে বলেছি, জামিন চাওয়ার অন্যতম কারণ সাহেদ অসুস্থ। পাশাপাশি তার বাবা মারা গেছেন বলে তিনি শোকাহত। তিনি বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক, দেশ ছেড়ে কোথাও যাবেন না। তাই তাকে রিমান্ডে নেয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তবে আদালত আমাদের আরজি মঞ্জুর না করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।’
কাঠগড়ায় সাহেদের কান্না ও করোনা আক্রান্তের প্রলাপ-
আদালতে রিমান্ড শুনানি চলাকালে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের উদ্দেশে সাহেদ বলেন, ‘আমি কি একটা কথা বলতে পারি?’ এটি বলে সেখানেই অশ্রুশিক্ত হয়ে পড়েন সাহেদ।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি দেড় মাস ধরে করোনায় আক্রান্ত। আমার বাবা করোনায় মারা গেছেন। আমি মার্চের প্রথম দিন যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাই, তখন তারা আমাকে আমার হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন করতে বলেন। তখন আমি বলি, আমার লাইসেন্সের ঘাটতি আছে। তখন তারা বলে, লাইসেন্স নবায়নের জন্য সোনালী ব্যাংকে টাকা জমা দেন। আমি তাদের কথা মতো টাকা জমা দেই। সারা দেশে করোনা চিকিৎসার কাজ বেসরকারিভাবে আমরাই শুরু করেছি। তারপরেও আমার সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে।’
কাঠগড়ায় বারবার পানের জন্য পানি চান সাহেদ-
সাহেদকে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিমের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময় তাকে রাখা হয় কাঠগড়ায়। আসামিদেরকে চেনার জন্য সাহেদ-মাসুদ ও তারিকুলের মাথার হেলমেট খুলে দেন পুলিশ সদস্যরা। এরপর পুলিশকে উদ্দেশ্য করে সাহেদ বলেন, ‘আমার হাতের হ্যান্ডকাপ খুলে দেন’। খুলে দেয়া হয় হ্যান্ডকাপ।
এরপর সাহেদ পানি খেতে চান। এরমধ্যে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এ সময় তিনি আবারও পানি খেতে চান। তখন আদালতের এক স্টাফ তাকে একটি পানির বোতলে করে পানি দেন। সে অনেকটা পানি পান করে বোতল আবার আদালতের স্টাফকে নিয়ে দেন।
এরপর তাদের কাঠগড়া থেকে বের করা হয়। এ সময় সাহেদ আবারও পানি চান। তখন এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘এত ঘন ঘন পানি চাইলে কীভাবে হবে? একটু আগে তো আপনি পানি খেলেন। রিমান্ডের আসামিকে এভাবে পানি দেয়া ঠিক না। তদন্তকারী কর্মকর্তা আছেন তাকে বলেন।’
এ সময় সাহেদের আইনজীবীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে যান। তারা বলেন, ‘একজন মানুষ পানি খেতে চাচ্ছে, আপনারা তাকে পানি দিচ্ছেন না’।
যেভাবে গ্রেফতার হলেন সাহেদ-
বুধবার (১৫ জুলাই) ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার শাখরা কোমরপুর বেইলি ব্রিজের পাশে নর্দমার মধ্যে থেকে বোরকা পরা অবস্থায় সাহেদকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গ্রেফতার এড়াতে গত কয়েকদিন ধরেই সাহেদ নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন। অর্থাৎ একদিন এ জায়গায় তো পরেরদিন অন্য জায়গায়। র্যাব তাকে ফলো করে। গ্রেফতার বিষয়ে র্যাব মহাপরিচালক জানান, ‘সে ঢাকা ছেড়েছে আবার ঢাকায় ফিরেছে, আবার বেরিয়েছে। এসবের মধ্যেই ছিল। এই পুরো সময়টাতে সে কখনও ব্যক্তিগত গাড়ি, কখনও হেঁটে, কখনও ট্রাকে চলাচল করেছিল। অবশেষে নৌকা দিয়ে পার হওয়ার সময় আমরা তাকে ধরতে সক্ষম হয়েছি’।
সাহেদের গ্রেফতারের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল ইসলাম জানান, ফজরের নামাজের জন্য তিনি মসজিদে গিয়েছিলেন। নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই তাদের কানে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। শুরু হয় হইচই। ঘটনা কী দেখার জন্য দৌড়ে যান সবাই। গিয়ে যা দেখলেন, সারা দেশের আলোচিত প্রতারক সাহেদ করিমকে ধরে ফেলেছে র্যাব।
সেরা নিউজ/আকিব