অনলাইন ডেস্ক:
সময়টা ১৯০৬ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ব্রংস নামক একটি চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয় ওটা বেঙ্গা নামে এক কৃষ্ণাঙ্গকে। শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার “অপরাধে” তাকে স্থান দেওয়া হয় বানরের খাঁচায়। ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার, ছোট-খাটো গড়নের, তীক্ষ্ণ-ধারালো দাঁতের এ মানুষটি সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাতে বর্তমানে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের অধিবাসী ছিলেন তিনি। নিশানা লক্ষ্য করে ধনুক দিয়ে তীর ছুঁড়ে মারার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ বেঙ্গাকে ১৯০৪ সালে অপহরণ করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয়।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাঁচাবন্দি বেঙ্গাকে দেখে অনেকে বুঝতে পারতেন না তিনি মানুষ নাকি পশু। এমনকি তার খাঁচার বাইরে একটি নোটিসে “সেপ্টেম্বর মাসের প্রত্যেকদিন দুপুরে তাকে প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে” বলেও লেখা ছিল। দর্শকদের আনন্দ দান করার জন্য জামা-কাপড় পরিয়ে রাখা হলেও খালি পায়ে থাকতেন বেঙ্গা।
সে সময় প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকামারফত জানা যায়, দর্শনার্থীদের জন্য “অত্যন্ত আকর্ষণীয়” ছিলেন তিনি। বিশেষ করে শিশুরা তাকে দেখে খুব মজা পেতো, হাসাহাসি করতো এবং জোরে চিৎকার করে উঠতো। কোনো কোনোদিন খাঁচার আশেপাশে একসঙ্গে পাঁচশত লোকও জড়ো হতো বেঙ্গাকে দেখতে।
বিবিসি জানায়, বেঙ্গার পরিচিত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে ব্রংস চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। কিন্তু চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাকে বন্দি করে রাখার পক্ষে যুক্তি দিতে শুরু করে। কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয় তাকে প্রদর্শনের জন্য সেখানে আটকে রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে তার নিরাপত্তার স্বার্থে, যাতে করে সে এখান থেকে পালিয়ে যেতে না পারে। ওটা বেঙ্গাকে বন্দি করে রাখার এই ইতিহাস ধামাচাপা দিতে কর্তৃপক্ষের তরফে কয়েক দশক ধরে নানা ধরনের চেষ্টা চালানো হয়। একপর্যায়ে বেঙ্গাকে চিড়িয়াখানার কর্মী বলেও দাবি করতে থাকে কর্তৃপক্ষ। পরে ওই বছরের ২৮শে সেপ্টেম্বর মুক্তি দেওয়া হয়।
জানা যায়, খ্রিস্টান নেতাদের সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে তার বন্দিত্বের অবসান ঘটে। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নিউইয়র্কে কৃষ্ণাঙ্গ এতিমদের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে যার নাম ছিল হাওয়ার্ড কালার্ড অরফান অ্যাসাইলাম। আফ্রিকান আমেরিকান রেভারেন্ড জেমস এইচ গর্ডন এটি পরিচালনা করতেন। ১৯১০ সালের জানুয়ারিতে তিনি চলে যান ভার্জিনিয়ায়। সেখানে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মিত লিঞ্চবার্গ থিওলজিক্যাল সেমিনারি এন্ড কলেজে বসবাস করতেন। সেখানে তিনি স্থানীয় ছেলেদের মাছ ধরা ও তীর ধনুক দিয়ে শিকার করা শেখাতেন। এছাড়াও তাদেরকে তিনি তার নিজের দেশের অ্যাডভেঞ্চারমূলক গল্প শোনাতেন। সেখানকার লোকজন বলেছেন যে ওটা বেঙ্গা রাতের আকাশের নিচে আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নাচতেন ও গান গাইতেন। পরে তিনি দেশে ফেরার জন্য আকুল হয়ে পড়েন। কিন্তু প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কারণে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে তিনি আর আফ্রিকায় ফিরতে পারেননি। তখন তিনি আক্রান্ত হন বিষণ্ণতায়। বেশিরভাগ সময় তিনি গাছের নিচে চুপ করে বসে থাকতেন। এরপর ১৯১৬ সালের মার্চ মাসে তার নিজের কাছে লুকিয়ে রাখা একটি বন্দুক দিয়ে বুকের মধ্যে গুলি করে তিনি আত্মহত্যা করেন।
এই ঘটনার ১১৪ বছর পর তাকে খাঁচায় ভরে প্রদর্শনের জন্য ক্ষমা চেয়েছে নিউইয়র্কের ওই চিড়িয়াখানাটি পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি। যদিও এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে লেগে যায় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের এক শতাব্দীরও বেশি সময়। সংস্থাটি ইতিহাসের এই অসম্মানজনক অধ্যায়ের নিন্দা জানিযে বলেন, “এই ঘটনার কারণে এবং আমাদের নিন্দা না জানানোর কারণে এতোদিন যে অনেক মানুষ আহতবোধ করেছেন তাতে আমরা অনুতপ্ত।”
সেরা নিউজ/আকিব