অনলাইন ডেস্ক:
“আমার আশা নর্ড স্ট্রিম-২ নিয়ে আমাদের অবস্থান পরিবর্তনে রাশিয়া আমাদের বাধ্য করবে না।” কয়েকদিন আগে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস এ কথা বলার পর আবারো বেগ পেয়েছে বাল্টিক সাগরের গ্যাস রাজনীতি। শিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির ওপর বিষ দিয়ে হামলার ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় তিনি এ মন্তব্য করেন।
বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করে। নর্ড স্ট্রিম-১ নামে একটি পাইপলাইন দিয়ে এ কাজ চলমান রয়েছে। যেটি চালু করা হয় ২০১১ সালে। তবে নর্ড স্ট্রিম-২ চালু করা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। এটি বন্ধে গত বছরই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে পাইপলাইনের শেষ অংশের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয় এটির ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘অলসিস’।
সে সময় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর করে দেয়ার জন্য নিজেরাই বাকি কাজ সমাপ্ত করে এ বছর শেষ হওয়ার আগেই প্রকল্পটি চালু করার ঘোষণা দেয় মস্কো। যদিও প্রকল্পটি রাশিয়া চেয়েছিল ২০২১ সালের চালু করতে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার জবাবেই এক বছর আগেই কাজ শেষ করতে চায় রাশিয়া। এতে নড়ে চড়ে বসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি দেশসহ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা। এবার সে দলে যোগ দিলো খোদ জার্মানিও। যারা এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী বা স্টেক হোল্ডার।
এটি এখন আর অর্থনৈতিক কোনো প্রকল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। রাশিয়া ও ইউরোপের যে সামরিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সেখানে ট্রাম কার্ড হিসেবে উঠে আসছে এই প্রকল্প। প্রকল্পটির গুরুত্ব যখন এতই বেড়েছে তখন মিত্রদের অখুশি করতে না রাজ জার্মান সরকারও। তবে, ২৪৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি মধ্যে ২,৩০০ কি.মি. লাইন বসানো হয়ে গেছে। এমন একটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখতে চাইবে না রাশিয়াও। যখন এটি দেশটির জ্বালানি সম্পদ রফতানির অন্যতম মাধ্যম এবং আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিমণ্ডলে আধিপত্য ধরে রাখার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে তখন এটি চালু করতে আরো বেশি মরিয়া হয়ে উঠছে ভ্লাদিমির পুতিন সরকার।
রাশিয়ার বিপুল পরিমাণ খনিজ জ্বালানি বিদেশে রফতানি করতে মরিয়া পুতিন সরকার। এর জন্য বেশ কিছু বড় প্রকল্প পরিচালনা করছে তারা। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে, ইউক্রেইনের মাধ্যমে ইউরোপের কাছে গ্যাস বিক্রি। সাইবেরিয়া থেকে চীনে গ্যাসের পাইপলাইনের কাজ চলমান রয়েছে। অন্যদিকে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে তুরস্কের কাছে রফতানি করাছে গ্যাস। যদিও তুরস্ক কৃষ্ণ সাগরে নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় খনিজ গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। এবং এটি পাওয়ার পর দেশটি সম্ভবত বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে দেবে। এমনটাই আভাদ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান। তাই রাশিয়াকেও নতুন ক্রেতা তৈরিতে মনোযোগি হতে হচ্ছে।
অন্যদিকে বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলছে, ‘নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্পের মাধ্যমে জার্মানি গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। মডার্ন ডিপ্লোম্যাসি সাময়িকীতে এক নিবন্ধে পিটার করযন উল্লেখ করছেন, অন্যদিকে বাল্টিক দেশগুলো এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে এই কারণে যে এই পাইপলাইনকে রক্ষার জন্য রুশ নৌবাহিনী পুরো অঞ্চল জুড়ে টহল দিতে থাকবে। রাশিয়া এমনকি তার সামরিক অভিযানের জন্য একে ব্যবহারের সুযোগ পাবে। এতে এসব দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।’
বিবিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. মাস, অ্যালেক্সি নাভালনির ওপর হামলার তদন্ত করার জন্য রুশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তা না হলে নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প বাতিল হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত করেন। নাভালনি বার্লিনের হাসপাতালে যখন কোমা থেকে বেরিয়ে আসছিলেন তার ঘণ্টা কয়েক আগে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল জানিয়েছিলেন, ঐ পাইপলাইনের প্রতি সমর্থন তিনি পুনর্বিবেচনা করতে প্রস্তুত আছেন। পরে তার একজন মুখপাত্র বলেন, “পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন মিসেস মের্কেল তার সাথে একমত।”
তবে অ্যাঙ্গেলা মর্কেলের সরকার নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে খুব বেশি উৎসাহী নয়। কারণ প্রকল্পটি তার আগের মধ্য-বামপন্থী চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রয়েডারের আমলের। ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে শ্রয়েডারের খুবিই ঘনিষ্ঠতা ছিল। ফলে প্রকল্পটি নিয়ে মর্কেলের একটা অনাগ্রহ দৃশ্যমান। শ্রয়েডার নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে খুব উৎসাহ দেখান। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে তিনি এই প্রকল্প নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি।
এটি চালু হলে ইউরোপীয় দেশগুলো কম দামে গ্যাস সংগ্রহের সুযোগ পাবে ঠিকই কিন্তু এর মাধ্যমে রাশিয়া ইউরোপের ওপর নিজের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করবে সহজে। তাই আমেরিকা রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় এ প্রকল্পে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এবং এই প্রকল্পের সাথে জড়িত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ট্রাম্প সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে। ফলে মর্কেল সরকার ইউরোপীয় দেশগুলোর তরফে থেকে বেশ চাপের মুখে পড়েছেন। এখন রাশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা নাভালনির ঘটনাকে কেন্দ্র করে নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে জার্মানিতে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে।
কিন্তু এই প্রকল্পটি এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং ইতোমধ্যেই এর পেছনে প্রায় ১০০০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। এই পর্যায়ে প্রকল্পটি বাতিল করার যুক্তি নিয়ে বিতর্ক চলছে। এখন এই প্রকল্প বাতিল হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থিতিশীল একটি অঞ্চল সেই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দামও বেড়ে যাবে। তাদের আরও যুক্তি: প্রকল্প বাতিল হলে বিকল্প কোন উৎস থেকে জার্মানিকে গ্যাস আনতে হবে।
যদিও বিবিসি বলছে, অনেক জার্মান এই প্রকল্পকে সমর্থন করেন। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর বিরোধী। অনেক জার্মান ট্রাম্পকে খুব অপছন্দ করেন। এবং এই পাইপলাইনের বিরুদ্ধে মি. ট্রাম্পের অনর্গল কথাবার্তা এর প্রতি সমর্থন আরও বাড়াতে সাহায্য করেছে। অনেক ভোটার মনে করেন তিনি এই প্রকল্প বাতিল করে তার জায়গায় আমেরিকান গ্যাস রপ্তানির সুযোগ খুঁজছেন। তবে প্রকল্প বাতিল হলে বিরাট অংকের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে জার্মানিকে।
মর্কেল নর্ড স্ট্রিম-২ যদি সত্যিই বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন, তার জন্য সবচেয়ে সহজ কৌশল হবে নীরবে সরে আসা। মার্কিন এবং ইউ’র বিরোধিতা প্রকল্পটিকে একেবারে শেষ করে দেবে। আর তাতে সম্ভবত এর ব্যয়ভারও জার্মানির ওপর বর্তাবে না। অন্যথায় জার্মানিকে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে। এবং প্রকল্পের এখন পর্যন্ত হওয়া খরচের বোঝা জার্মানিজের মাথায় চাপানোর সুযোগ তৈরি হবে রাশিয়ার জন্যও।
সেরা নিউজ/আকিব