বিশেষ প্রতিবেদক:
ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুপমেন্ট আইডেন্টি নাম্বার (আইএমইআই) পরিবর্তন করে চোরাই মোবাইলফোন বিক্রি করে আসছে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র। গত কয়েক বছর যাবৎ এসব চক্র সক্রিয় রয়েছে। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। বিশেষ ডিভাইস ব্যবহার করে প্রযুক্তিতে দক্ষ এক শ্রেণির বিপথগামী এসব করে থাকে। আইএমইআই বদলে এসব ফোনসেট ব্যবহার করছে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা। এমনকি শীর্ষ একটি মোবাইলফোন সেট তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তাও এতে জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, রাজধানীর দু’টি স্থানে বিক্রি হয় চোরাই মোবাইলফোন। শেষ রাতে এসব স্থানে ফোনের হাট বসে। এসব হাট থেকে চোরাই মোবাইলফোন কম দামে কিনে আইএমইআই বদলকারী চক্রের সদস্যরা।
পরবর্তীতে আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রি করে তারা। তবে আই ফোনের আইএমইআই পরিবর্তন করতে পারে না চক্রের সদস্যরা। যে ফোনের আইএমইআই পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না তা বিদেশে পাচার করে দেয়। সূত্রমতে, গত কয়েক বছরে বিপুল মোবাইলফোন পাচার করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। অবৈধভাবে এসব মোবাইলফোন পাচার করা হয়। এরমধ্যে আই ফোনের সংখ্যা বেশি। এই কোম্পানিটি নিজস্ব উন্নত ব্যবস্থাপনায় ফোনের মাদার বোর্ড তৈরি করে থাকে। যে কারণে অন্য কোনো ডিভাইস দিয়ে ওই আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। সাতক্ষীরা, যশোর, বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে এসব ফোন ভারতে পাঠানো হয়। একইভাবে ভারত থেকে চোরাইফোন প্রায়ই দেশে আসছে। এসব ফোন বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে। বিভিন্নস্থান থেকে চুরি যাওয়া ফোন বিক্রি হয় রাতের আঁধারে। মিরপুরের পল্লবীতে একটি রাতের হাট বসে। সেখানেই বিক্রি হয় এসব ফোন। একইভাবে গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট ও মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম মার্কেটে বিক্রি হয় এসব ফোন। গুলিস্তানের পাতাল মার্কেটের কবির টেলিকম, বিসমিল্লাহ টেলিকম, মাসুদ টেলিকম, মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম মার্কেটের আলী স্পোর্টস, সিমলা ইলেক্ট্রনিক, সাকিব ইলেক্ট্রনিক, আজমেরি ইলেক্ট্রনিক্স, আবির ইলেক্ট্রনিক্স, সুমাইয়া টেলিকম, ইলেক্ট্রনিক্স কর্নার, ইলোক কনিক্স কর্নার, আল আমিন ইলেক্ট্রনিক্স, রহমত ইলেক্ট্রনিক্স ও সিটি ইলেক্ট্রনিক্সসহ ওই এলাকার বিভিন্ন দোকানে এসব ফোন বিক্রির প্রমাণ রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে। অতীতে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে জড়িতদের।
সম্প্রতি এসব চক্রের ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। আইএমইআই পরিবর্তনের পর স্বল্প দামে সেগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে বিক্রি করতো তারা। সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজীব ফরহান জানান, এসব চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করার পর চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে সিআইডি। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে চুরি যাওয়া ২৬৫টি মোবাইলফোন এবং আইএমইআই পরিবর্তনের কাজে ব্যবহৃত নয়টি ডিভাইস। তাদের দেয়া তথ্যানুসারে, বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বল্পদামে চোরাই ফোনগুলো কেনে এই চক্রের হোতা মুরাদ ও লাবলু। তারপর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে আইএমইআই পরিবর্তনের জন্য সেগুলো দেয়া হয় প্রযুক্তিতে দক্ষ অনিক, বশির ও মালেকের কাছে। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা তাদের সহযোগী বলে জানান তিনি।
অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি ছিনতাইকারী ও চোরদের কাছ থেকে ফোন ক্রয় করে আইএমইআই পরিবর্তনকারী চক্রের সদস্যরা। আবার কোনো কোনো ব্যবসায়ীরাও এই চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে আইএমইআই পরিবর্তন করে নেন। সাধারণত একটি সেটের আইএমইআই পরিবর্তন করার জন্য ৫শ’ থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। এসব কাজে দামি ফ্ল্যাশ ডিভাইস ব্যবহার করছে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে জঙ্গি থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপরাধে জড়িতরাই এসব মোবাইলফোনের মূল ক্রেতা বলে জানান গোয়েন্দারা। এর ফলে প্রায় সময়ই অপরাধীদের শনাক্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। গত বছরের শেষের দিকে বিষয়টি নজরে আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। জঙ্গিবাদ, অপহরণ, মাদক, চাঁদাবাজি, গুম ও হত্যাসহ নানা বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক ফোনই ট্র্যাকিং করা যাচ্ছে না। ফলে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছিল। পরে দেখা গেছে এসব ঘটনায় ব্যবহৃত মোবাইলের আইএমইআই নম্বর ঠিক নেই। আইএমইআই ১৫ ডিজিটের একটি নম্বর, মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরি করার সময় এর মধ্যে প্রোগ্রাম করা থাকে। এই নম্বরটি মূলত মোবাইল হ্যান্ডসেটটির পরিচয় বহন করে। আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের ফলে এতে ব্যবহৃত ফোন নম্বরটি প্রযুক্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। যে কারণে অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে নিজেদের আড়ালে রাখতে এ ধরনের সেট ব্যবহার করে থাকে। সূত্রমতে, একটি শীর্ষ মোবাইলসেট কোম্পানির কিছু কর্মকর্তাও আইএমইআই বদলকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। ফোনসেট তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা নতুন আইএমইআই নম্বর দিতে পারেন। ওই কোম্পানির কিছু কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে ঘণ্টা হিসেবে তাদের ব্যবহৃত পাসওয়ার্ড বিপথগামী ওই চক্রের হাতে দিয়ে থাকেন। এর মাধ্যমে ওই কোম্পানির চোরাই সেটগুলো আইএমইআই পরিবর্তন করে নতুন আইএমইআই দেয়া হয়।
এসব বিষয়ে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি সাফি কনসালটেন্সি’র লিড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সুমন চৌধুরী বলেন, অতীতে সিম ক্লোন করা হয়েছে। এখন যদি ফোনসেটের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে অপরাধ সংঘটন করলেও তাদের গ্রেপ্তার করা কঠিন হয়ে যাবে। আইএমইআই পরিবর্তন করার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ওই ফোনের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে না। একইভাবে ফোন নম্বরটিও জানা যাবে না। এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
সেরা নিউজ/আকিব