সেরা নিউজ ডেস্ক:
২০১৬ সালের ঘটনা। ছোট্ট আলেক্সান্ডারের থেকে থেকে কান্না। নির্বাচনের হতাশাজনক খবর দেখেই তার এমনটি হয়েছে। নির্বাচনে নেতিবাচক ফলাফল হতে পারে এমন কথা বলে কেউ তাকে ভেঙচিয়েছে। আলেক্সান্ডারকে থামানো হয় এই বলে, ভিলেনদের জন্য সুপার হিরোদের সবসময়ই বড় রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। আর শেষ পর্যন্ত সুপার হিরোরা লড়াইটা চালিয়ে যায়। আমরা সেই কাজটিই করছি। যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য নির্বাচিত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস তার জীবনীভিত্তিক বই ‘The Truth We Hold’ বইতে এ কথাই বলেছেন।
বইয়ের শুরুতে মুখবন্ধে তিনি আরও বলেন, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী সিনেটর নির্বাচিত হওয়া ছিল আমার জীবনের সেরা সম্মান। সেদিনের ঘটনা ভাবলে আমার কাছে এখনও সবকিছু কাল্পনিক মনে হয়।
পিতা ডনাল্ড হ্যারিস মার্কসবাদী। মাতা শ্যামলা গোপালান কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আদায়ের সংগ্রামী কর্মী। কৈশোরে মায়ের সঙ্গে গিয়েছেন মন্দিরে। পিতার সঙ্গে চার্চে। বিয়ের পর সৎ সন্তানেরা তাকে ডাকতে শুরু করেন আদুরে গলায় ‘মমালা’ বলে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যিনি পরিচিত ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত এক রাজনীতিক হিসেবে। তিনটি অনন্য রেকর্ড যার গলায়। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ, নারী ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট। কমালা হ্যারিসের চমকের শেষ নেই। যার ধমনীতে মিশে আছে তিন মহাদেশ। আফ্রিকা, আমেরিকা এবং এশিয়া। তার নাটকীয় উত্থানের নানা কথা লিখেছেন ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘The Truth We Hold’ বইতে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্যাঙ্গুইন বুকস লন্ডন থেকে। এর প্রথম অংশ সেরা নিউজের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো আজ।
আমার সকাল শুরু হয় বিছানায় খবরের কাগজ পড়ে। বেশির ভাগ দিনই সকালে আমার স্বামী ডগ (ডগলাস) আমার আগে ঘুম থেকে জেগে যায় এবং বিছানায় বসেই খবরের কাগজগুলো পড়ে ফেলে। যেদিন তাকে যন্ত্রণাকাতর হয়ে চিৎকার করতে শুনি বা দীর্ঘশ্বাস নিতে দেখি সেদিন আমি বুঝতে পারি দিনটি কেমন যাবে?
২০১৬ সালের ৮ই নভেম্বর দিনটি ভালোভাবেই শুরু হয়েছিল। দিনটি ছিল সিনেট নির্বাচনে আমার প্রচারণায় অংশ নেয়ার শেষ দিন। পুরোদিন অনেক ভোটারের সঙ্গে আমার সময় কেটেছে। আমার বাড়ির কাছেই একটি স্কুলে নিজের ভোটটি দিই। একটি ভোটের জন্য আমি তখন ছুটে বেরিয়েছি প্রতিবেশী থেকে শুরু করে বিদ্যালয় এমনকি পথচলা মানুষদের কাছেও। আমার কাছে বিষয়টি বেশ ভালোই লাগছিল। নির্বাচনের রাতে একটি পার্টি দেয়ার জন্য বেশ বড় একটি জায়গা ভাড়া নিয়েছিলাম। যেখানে বেশ বড় একটি ব্যালকনি ছিল। আমার প্রথম প্রচারণা থেকেই এই রীতির প্রচলন। সে অনুযায়ী এ রাতে প্রথমেই আমি আমার পরিবার ও কাছের বন্ধুদের নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেই।
রাজ্যের নানা প্রান্তের এমনকি বিদেশ থেকে আসা লোকজনের ঢল নেমেছিল সেই রাতে। অনুষ্ঠানে আমার নিকটাত্মীয় বিশেষ করে খুড়তুতো ভাইবোনেরা, ননদ, দেবরসহ শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও যোগ দিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল সেই রাতটি বিশেষ কোনো রাত হবে। গাড়ির জানালা দিয়ে আমি বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম কতটা পথ পেরিয়ে এসেছি। ভিড়ের মধ্যে ডগের (ডগলাস) চিৎকার কানে ভেসে আসতে লাগলো। তার ফোন আমার হাতে দিয়ে বললো, তুমি এটা দেখো। প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনের প্রাথমিক ফলাফল আসতে শুরু করেছে। কিছু ভালো খবর আবার কিছু খারাপ খবরও আসছে। এরই মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই রেস্তরাঁয়। ততক্ষণে নির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে পার্থক্যটা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসছিল। আমি ভেতরে ভেতরে কৌতূহল অনুভব করছিলাম। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সম্ভাবনা সূচক যে আভাস দিয়েছিল তার সবকিছু পরিষ্কার হতে আরো সময় লাগবে। রাত কেবলই যেনো দীর্ঘ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হচ্ছিল।
আমরা রেস্তরাঁর মূল অংশে একটি ছোট কক্ষে খাবারের অপেক্ষায়। আবেগ, উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক চাপ বেড়েই চলছিল। কিন্তু এটা এজন্য নয় যে, পূর্ব থেকেই কিছু একটা অনুমান করতে পারছিলাম। ক্যালিফোর্নিয়ার পুরোপুরি ফলাফল আসার আগেই আমি আশাবাদী ছিলাম জয়ের ব্যাপারে। এটাও ঠিক জয়কে সেলিব্রেশন করার জন্য একরকমের প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। সকলের চোখ তখন কি হয় সেদিকে। রাজ্যের বিভিন্নস্থান থেকে হতাশাজনক খবরের অপেক্ষায়।
একটা সময় নয় বছর বয়সী গডসন আলেক্সান্ডার আমার কাছে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। বুঝতে পারি, নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অন্যদের সন্তানেরা তাকে ভেঙচিয়েছে।
– এখানে আসো, সোনা বাবা, কি হয়েছে?
আলেক্সান্ডার আমার দিকে তাকালো এবং আমার চোখে তার চোখ রাখলো। তার গলার স্বর কাঁপছিল। সে আমার দিকে এসে কান্নাজড়িত চোখে ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে শুরু করে, ‘আন্টি কমালা, ঐ মানুষটি জিততে পারে না। সে কখনই জিতবে না। এটা কি ঠিক?’
আলেক্সান্ডারের দুশ্চিন্তা আমার হৃদয় ভেঙে দিলো। কেউ বাচ্চাদেরকে এভাবে কষ্ট দিক এমনটা আর দেখতে চাই না। আট বছর আগে বারাক ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন আমাদের অনেকেই আনন্দে কেঁদেছিলাম।
আর এখন আলেক্সান্ডারের কান্নাজুড়ে আছে ভয়। আমি তার পিতা রিগিকে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে নানাভাবে শান্ত করার চেষ্টা করি।
আলেক্সান্ডার তুমি তো নিশ্চয়ই জানো কখনও কখনও সুপার হিরোদের ভিলেনদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। তখন তারা কি করে? তারা লড়াইটা চালিয়ে যায়।
এটা ঠিক- আলেক্সজান্ডার কেঁপে কেঁপে বলে ওঠে।
আর তারা লড়াইটা চালিয়ে যায় আবেগকে সঙ্গী করে। কারণ সত্যিকার সুপার হিরোদের রয়েছে তোমার মতো আবেগ। কিন্তু তারা লড়াই চালিয়ে যায়, এটা তো ঠিক? সুতরাং, আমরাও সেই কাজটি করছি।
এর অল্প পরে এসোসিয়েট প্রেস আমার নির্বাচন নিয়ে কথা বলবে। সে সময় পর্যন্ত আমরা রেস্তরাঁতেই আছি।
সব সময় আমার সঙ্গে যারা আছে প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য সকলকে যথেষ্ট ধন্যবাদ দিতে পারি না। এ কথাটি আমি আমার অবিশ্বাস্যরকম ভালোবাসাময় এবং সমর্থন দেয়া পরিবার এবং বন্ধুদের বলে এসেছি। আমার কাছে এর অর্থ অনেক বেশি। ঐ রুমের ভেতরে যারা ছিলেন এবং যেসব মানুষকে আমি হারিয়েছি বিশেষ করে আমার মা। কৃতজ্ঞতায় তাদের প্রতি আমি অবিভূত।
আমি চলমান পরিস্থিতিতে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছি। প্রতি মুহূর্তে চোখ রাখছি টেলিভিশনের দিকে।
রাতের খাবার শেষে আমরা পৌঁছলাম আমাদের নির্বাচনী ক্যাম্পে। যেখানে পার্টি করতে সমবেত হয়েছে হাজারও কর্মী- সমর্থক। তখনও আমি এই পদের প্রার্থী নই।
তখন আমি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর নির্বাচিত। ক্যালিফোর্নিয়ায় আমি প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ নারী সিনেটর অন্যদিকে পুরো আমেরিকায় দ্বিতীয়। আমি তিন কোটি নব্বই লাখ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে নির্বাচিত হয়েছি। সেটাই ছিল আমার জীবনে সেরা সম্মান।
মঞ্চের পেছনে গ্রিন রুমে যখন আমি যোগ দিলাম তখন আমার দলের নেতাকর্মীরা হাততালি দিয়ে উল্লাস করতে লাগলো। সেদিনের ঘটনা ভাবলে এখনো আমার কাছে সবকিছু কাল্পনিক মনে হয়। কেউ পরিপূর্ণভাবে বুঝে ওঠতে পারেনি কী ঘটতে চলেছে। তারা আমাকে ঘিরে একটি বৃত্ত তৈরি করে। তারা যা করেছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই এবং বলি, আমরা এক পরিবার। আমরা অবিশ্বাস্যভাবে একত্রিত হয়ে একটি যাত্রা শুরু করেছি। সেদিনের সেই নতুন সূচনায় অনেকেই আমার সঙ্গে ছিলেন, ডিস্ট্রিক অ্যাটর্নি হিসেবে যখন আমি প্রচারণা শুরু করেছিলাম। কিন্তু এখন দু’বছর পরে নতুন করে প্রচারণা শুরু হলো। আমরা নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছাবার জন্য কাজ শুরু করেছি।
আমি আমার লিখিত বক্তৃতা তৈরি করি হিলারি ক্লিনটন দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন এমনটি ভেবে। আমি যখন আমার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতে মঞ্চে উঠবো তখন খেয়াল হলো ভুলবশত সেই লিখিত খসড়াটি বাসায় ফেলে এসেছি। আমি রুমের চারদিকে তাকিয়ে দেখি মেঝে থেকে বারান্দা সর্বত্র লোকে লোকারণ্য। জাতীয় নির্বাচনের যে ফল তা দেখে অনেকেই হতাশ।
আমি সমবেতদের উদ্দেশ্যে বললাম, আমাদের সামনে কিছু কাজ বাকি আছে। আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমাদের জাতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য, মৌলিক অধিকার রক্ষায় এবং নীতি ও আদর্শ সুরক্ষায়।
আমি আলেক্সান্ডারের কথা ভেবে সকল শিশুদের কাছে প্রশ্ন রাখি- আমরা কি পেছন দিকে যাবো নাকি লড়াই করবো? আমি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করি। এবং পুনরায় সেই অভিপ্রায় ব্যক্ত করি।
আমি আমার পরিবারের সকলকে নিয়ে বাসায় ফিরি। সেই রাতে আরো অনেকেই ছিল। ঘামে ভেজা অবস্থায় সকলেই লিভিং রুমে একসঙ্গে টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষায়। কেউ কেউ বসেছে মেঝেতেও। নানা পরিকল্পনার কথা সকলেই বলাবলি করছিল।
কেউই আসলে জানতো না কি বলা দরকার বা কি করা দরকার। সকলেই নিজেদের মতো পরিস্থিতি সামাল দিতে লাগলো। আমি ডগের (ডগলাস) সঙ্গে খাটে বসে একাই একটি ক্ল্যাসিকেল সাইজের ডোরিটস খেলাম।
কিন্তু আমি জানতাম, একটি প্রচারণা শেষ হলেও আরেকটি প্রচারণা অপেক্ষা করছে। একটি প্রচারণা আরো নতুন নতুন প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত করেছে আমাদের। এটাই সময় জাতির জন্য লড়াইয়ের।
সেরা নিউজ/আকিব