স্বাস্থ্য ডেস্ক:
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় সর্বত্র বিশেষত, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক বৈষম্য প্রকট।
শিশু, কিশোরী বা মহিলা তার সমবয়সী ছেলে, কিশোর বা পুরুষের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা একদিকে যেমন স্বল্প হারে পেয়ে থাকেন; অন্যদিকে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা (ট্যাবু) ও প্রচলিত সংস্কার নারীকে তার রোগবালাই নিয়ে মুখ ফুটে অনেক কিছু বলতে শেখায় না।
তাই বয়সের বিভিন্ন স্তরে একজন নারী গোপনীয়তার তকমা লাগানো এমন অনেক রোগে দীর্ঘ সময় ভুগতে থাকে, যা তার শরীর ও মনের ওপর প্রভাব ফেলে।
মেনোরেজিয়া একজন নারীর জীবনে এমন এক ব্যাধি, যে ব্যাধি সম্পর্কে স্বয়ং নারীই অবগত থাকেন না। কিন্তু এ রোগের নেতিবাচক প্রভাব একজন নারীর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক; এমন কী তার স্বাভাবিক জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
সাধারণভাবে বলা যায়, মাসিক বা ঋতুস্রাব চলার সময় অধিক রক্তপাত হলে তাকে মেনোরেজিয়া বা অতি রজঃস্রাব বলে। ২০-৪০ বছর বয়সে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়।
নানাবিধ কারণে এ রোগের সূত্রপাত হয়। যেমন- হরমোনজনিত সমস্যা, জরায়ুতে টিউমার বা ক্যান্সার থাকলে, রক্তে কোনো সমস্যা থাকলে, জরায়ু বা ডিম্বনালিতে জীবাণু সংক্রমণ হলে, জননাঙ্গে সিস্ট থাকলে, ওভারিয়ান ক্যান্সার হলে, কিডনির অসুখ বা যকৃতের অসুখে, মাসিককালীন মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা ইত্যাদি।
২
অতিরিক্ত রক্তপাত হয়ে থাকে (পাভেল, ইনকিলাব ২০১৯)। কিন্তু শারীরিক এ ব্যাধির সঙ্গে সামাজিক অজ্ঞতা এ রোগকে অধিকাংশ নারীর কাছে করে তোলে বেনামি স্বাভাবিক ঘটনা।
ফলে এ অসচেতনতা, অজ্ঞতা ও অবহেলার ফল হতে পারে মারাত্মক। মাসিক বা ঋতুস্রাব একজন মেয়ের জীবনে খুব স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। মাসিক নিয়মিত বা স্বাভাবিকভাবে হওয়ার অর্থ হচ্ছে, মেয়েটি তার ভবিষ্যৎ জীবনে সন্তান ধারণে সক্ষম।
কিন্তু মাসিক সম্পর্কিত প্রচলিত ভুল ধারণা একজন মেয়ের জীবন করে তুলে দুর্বিষহ। প্রচলিত কুসংস্কারে একজন মেয়েকে কিশোরী বয়সেই জানানো হয়- প্রতি ২৮ দিন পরপর তার মাসিক চক্রে ৩ থেকে ৫ দিন ধরে শরীর থেকে যে রক্ত নিঃসৃত হয়, তা দূষিত রক্ত। সুতরাং এ রক্ত যত বের হবে, ততই ভালো।
কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে বয়ঃসন্ধিকালের পরবর্তী সময় থেকে মেনোপজের পূর্ব পর্যন্ত একজন নারীর শরীরে প্রতিমাসে একটি করে ডিম্বাণু তৈরি হয় এবং গর্ভধারণের সুযোগ করে দেয়।
এ ডিম্বাণুটি শুক্রাণু দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষিক্ত না হলে নষ্ট হয়ে যায় এবং প্রতি ২৮ থেকে ২৯ দিন অন্তর একজন নারীর শরীর থেকে এই নষ্ট ডিম্বাণু যোনিপথে রক্ত হয়ে বের হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ২১ দিনের পর; আবার কারও ক্ষেত্রে ৩৫ দিন পরও এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে থাকে।
সাধারণত একেই আমরা ঋতুস্রাব বা মাসিক বলে চিহ্নিত করি। এক্ষেত্রে যেটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হল- এ রক্তস্রাবে প্রবাহিত রক্ত কোনো অর্থেই দূষিত রক্ত নয়; বরং শরীরের স্বাভাবিক রক্ত। প্রতিটি ঋতুচক্রে গড়ে একজন মেয়ের শরীর থেকে ৩০ থেকে ৫০ মিলিলিটার, যা প্রায় ২ থেকে ৩ টেবিল চামচ; ক্ষেত্র বিশেষে ৪ টেবিল চামচ রক্ত বের হয় (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০)।
৩
কিন্তু যখন ৮০ মিলিলিটার বা তার থেকে বেশি (প্রায় ৬ টেবিল চামচ) রক্তপাত হয়, তখনই তাকে ভারি রক্তক্ষরণসহ অতিরিক্ত ঋতুস্রাব বা হেভি মেনস্ট্রুয়াল ব্লিডিং বলা হয় (সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২০২০)। একজন নারী কখন বুঝবেন- তার মেনোরেজিয়া হয়েছে?
সাত দিনের বেশি সময় উল্লেখযোগ্য হারে রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকলে, একবার ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে আবার শুরু হলে, এ সময় প্রায়ই রক্তের চাকা বের হলে, স্যানিটারি প্যাড প্রতি এক থেকে দুই ঘণ্টা পরপর পরিবর্তন করতে হলে বা একসঙ্গে দু’ধরনের প্যাড ব্যবহার করতে হলে।
রাতের ঘুমের মাঝখানে কেউ দেখলেন যে, প্যাড ভিজে গিয়ে বিছানা বা জামাকাপড়ে দাগ লেগে গেছে; তাহলে ধরে নিতে হবে তার মেনোরেজিয়া হয়েছে। এ সময় রক্তের সঙ্গে টিস্যু আর জমাটবাঁধা রক্ত (রক্তের চাকা) বের হয় বলে সব মিলিয়ে একজন নারীর কাছে বাস্তবিকের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে অধিক রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলে অনুভূত হয়, যা তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে।
সামাজিক রক্ষণশীলতায় একটি মেয়ে জানতেই পারে না, এ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ তার শরীরের জন্য কতটা ক্ষতি অথবা তার মেনোরেজিয়া হয়েছে কিনা; চিকিৎসা তো পরের বিষয়। তাই আমাদের গবেষণায় এখনও উঠে আসেনি বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনে কতজন নারী মেনোরেজিয়ায় আক্রান্ত।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, প্রতি ১০০০ জনের ৫৩ নারী এ রোগের শিকার (কৃষ্ণাভেনি ও অন্যান্য, ২০১৮)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মহিলা মনে করেন, ঋতুস্রাবকালীন তাদের রক্তপ্রবাহ অত্যধিক (mvg& ব্রুক ও কপার, কারেন্ট অবসট্রিক অ্যান্ড গাইনোকোলজি, ২০০৫)।
৪
এ সময় প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কারে নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা। শতকরা ৯৫ ভাগ নারীই তাদের মাসিককালীন নানাবিধ কুসংস্কারের শিকার হন (দ্য ডেইলি স্টার, ২০১৮)। বিশেষত, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে। ফলে সামাজিক কুসংস্কার নারীর মেনোরেজিয়ায় হওয়া শারীরিক ক্ষয়কে আরও বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশের ১০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রতি তিনজনের একজন নারী প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পায় না (দৈনিক প্রথম আলো, ২০১৯)।
চিকিৎসার অভাবে মেনোরেজিয়ার প্রভাবে একজন নারীর দীর্ঘকালীন বিভিন্ন যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক অনুভূতি যেমন- ব্যথা, খিটখিটে মেজাজ, মাথা ঘোরা, চোখে ঝাপসা দেখা, হরমোনের তারতম্যজনিত অস্বস্তি, ক্লান্তি ইত্যাদি একদিকে তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটিয়ে বিষণ্নতা সৃষ্টি করে; অন্যদিকে প্রভাব পড়ে তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে। এছাড়া অধিক রক্তপাতে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৪২ ভাগ মেয়ে বা নারী আয়রন বা রক্তে লৌহ-স্বল্পতায় ভুগছেন। অর্থাৎ প্রতি ১০ জন মেয়ের মধ্যে ৪ জন অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতার শিকার (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০১৬), যা পরবর্তী সময়ে আরও জটিল সমস্যার জন্ম দিতে পারে। এমন কী মাতৃমৃত্যুর কারণও হতে পারে। তবে ঠিক কত সংখ্যক নারী মেনোরেজিয়াজনিত রক্তস্বল্পতায় ভোগেন, তার কোনো পরিসংখ্যান আমরা জানি না।
৫
মেনোরেজিয়ায় শারীরিক দুর্বলতায় নারী তার নিয়মিত কাজকর্ম করতে উৎসাহ পায় না। মানসিক অবসাদে ভোগে। কিন্তু প্রতিমাসে নারীর এ বিশেষ দিনগুলোয় তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি পরিবারের অন্য সদস্যরা সহজে মেনে নিতে চায় না। অন্যদিকে গৃহকাজে মন নেই বলে আমরা খুব সহজেই নারীর ওপর দোষ চাপাই।
ক্ষেত্রবিশেষে, অনেক পরিবারে ঘরের কাজে অবহেলার জন্য নারীর গায়ে হাত তোলাও অস্বাভাবিক মনে করা হয় না। এ দেশে কত সংখ্যক নারী এ ধরনের শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঘরের কাজ করতে না পারায় পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা গবেষণা করি না।
সুস্থ পারিবারিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সুস্থ বা অসুস্থ যে কোনো অবস্থায় একজন নারীকে পরিবারে নানা ধরনের ভূমিকা পালন করতে হয়।
তাই হঠাৎ করে নারীর অস্বাভাবিক আচরণকে তার দোষ হিসেবে না ধরে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে সমস্যার কথা শুনে তাকে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে যত্নশীল হওয়া আমাদের সবারই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমরা কখনও জানতে চাই না- আমাদের নারীরা মাসের এ বিশেষ দিনগুলোতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারছেন কিনা।
তাই আয়রন ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি নারীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। সর্বোপরি, যে নারীর হাতে সংসারের হাল; তার মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন নিশ্চিত করতে পরিবারের সবার বিশেষত, পুরুষ সদস্যদের ইতিবাচক মনোভাব থাকা অত্যন্ত জরুরি।
লেখকদ্বয় যথাক্রমে সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
সেরা নিউজ/আকিব