বাবুল সিদ্দিক:
প্রয়াত ভাষা সৈনিক এম মুজিবুল হক এর জন্মদিন আজ। ব্যাক্তিগত কর্ম জীবনের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৫ সালে ভূষিত হন স্বাধীনতা পদকে। প্রয়াত এই ভাষা সৈনিক ১৯৩০ সালের ২ আগস্ট তারিখে বরিশাল জেলাধীন বানারিপাড়া উপজেলার গাভা রামচন্দ্রপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম মোবারক আলী সরদার।
জনাব মুজিবুল হক ১৯৪৭ সালে বানারিপাড়া উপজেলাধীন গাভা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত বিএম কলেজ থেকে বি, এ, অনার্স(ইংরেজি)কৃতিত্বের সাথে(with distinction)
পাশ করার পর ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি ভাষা আন্দলনের সাথে জড়িয়ে পরেন। ১৯৫২ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের তৎকালীন ভিপি হিসাবে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত থাকায় জেলও খেটেছেন।তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির প্রেক্ষিতে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় তিনিও উপস্থিত ছিলেন এবং পরের দিন ২১ ফেবুয়ারী রক্তাক্ত ঘটনায় তিনি পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শিকার হন।২২ ফেব্রুয়ারি তারিখের আন্দোলনে মুজিবুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।১৯৫২ সালের ৭ মার্চ শান্তি নগরে ডা: মোত্তালেব সাহেবের বাড়িতে যে গোপন বৈঠক হয়েছিল , সেখান থেকে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন।একমাস পর মুক্তি পান।ওই সময় পাঁচ দিন তাকে ইন্টারোগেশন সেলে রাখা হয়।১৯৫৪ সালে ইংরেজি সাহিত্যে কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স শেষ করেন।
পড়াশুনার শেষ করে জনাব মুজিবুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন পরে সেন্ট্রাল সুপরিয়র সার্ভিস ( সি,এস, পি ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন (১৯৫৫সাল)। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন মহকুমায় এসডিও, বিভিন্ন জেলায় ডিসি, হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং অত্যান্ত দক্ষতার পরিচয় দেন।উচ্চতর প্রশিক্ষন নিয়েছেন লাহোর একাডেমি ও অক্সফোর্ডে । তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের তথ্য, শিক্ষা,স্হানীয় সরকার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সচিব পদে ছিলেন।
মুজিবুল হক ১৯৫৫ সালে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি নিবাসী তৎকালীন পানি উন্নয়ন কতৃপক্ষ( ওয়াপদা) এর ইন্জিনিয়র মরহুম জনাব আকবর আলী খান এর কন্যা আরশেদা বেগম-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযাদ্ধের সময় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত থাকাকালীন সপরিবারে আটকা পরে যান। এ সময় তিনি অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও সাহসী পদক্ষেপ নেন। সপরিবারে অনেক দূরগম,পাহারী পথ পাড়ি দিয়ে পেশোয়ার হয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পৌঁছান। সেখান থেকে বাংলাদেশে আসেন। ১০ জানুয়ারী, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ ফিরে এলে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে আগে থেকেই চিনতেন খুব পছন্দ করতেন । বঙ্গবন্ধু তাকে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাস্ট্র সচিব হিসাবে নিয়োগ করেন। এরপর তিনি পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিপক্ষা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের সচিব হিসাবে কর্মরত ছিলেন।পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের সদস্য (কার্যক্রম)হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর সর্বশেষে জনার মুজিবুল হক মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসাবে তিন বৎসর অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সাথে দায়ীত্ব পালনের পর দীর্ঘ ৩৫ বৎসরের সরকারী চাকুরী সমাপ্তি টেনে সরকারের শীষ পদ থেকেই ১৯৮৯ সালে অবসরে যান।
সমাজ সেবা ও মানব কল্যানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অনন্য অবদান ও একজন সফল, দক্ষ প্রশাসক হিসাবে ১৯৯৩ সালে অতীশ দীপাঙ্কর পুরস্কার এবং ভাষা আন্দোলনে অনন্য অবদানের জন্য শহীদ সোহরাওয়াদী পুরস্কার লাভ করেন ১৯৯১ সালে। এছাড়াও ২০০৩ সালে জাতিসংঘের Human Resource Development তাকে ‘Rapport’ Bangladesh’ এডওয়ারডে ভূষিত করে।
১৯৮৯ সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহনের পর সরকার কর্তৃক গঠিত পঞ্চম ও ষষ্ঠ জাতীয় বেতন কমিশনের চেয়াম্যান, জাতীয় সম্পচার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাব দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ব্রিটিশ টোবাকো কোম্পানীর চেয়ারম্যান, গ্রীনলেজ ব্যাংকের এডভাইজারি কমিটির প্রেসিডন্ট সহ বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে কাজ করেন। এছাড়াও ডায়বেটিক এসোসিয়েসন অব বাংলাদেশ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন । মানুষের কল্যান ও তার অসাধারন এবং সামগ্রিক জীবনের কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৫ সালে মুজিবুল হককে সমাজ সেবায় ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে ‘ ভূষিত করা হয়। সরলতা,নিষ্ঠা, মার্জিত রুচিবোধ এবং পরিচ্ছন্ন মূল্যবোধের জন্য সর্বস্তরের মানুষের কাছে একজন সমাদৃত ব্যাক্তি ছিলেন তিনি।
জনাব মুজিবুল হক একজন বিশিষ্ট প্রশিক্ষক ছিলেন। তার অবসর জীবনের একটি বড় অংশই কেটেছে বিভিন্ন প্রশিক্ষন কক্ষে, বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষনাথীদের মাঝে। নিবিষ্ট অধ্যায়ন,নিষ্ঠা,সতর্ক অনুশীলনের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে তিলে তিলে গড়ে তুলে ছিলেন নিজেকে। অবয়বে,প্রশিক্ষন,ক্লাস, সেমিনার- ওয়াকশপ, আলোচনা সভা কিংবা সাক্ষাত্কারে ঘটেছে তার দীপ্ত প্রকাশ। অভিজ্ঞতা প্রসূত শিক্ষা, সূ- বিন্যস্ত উপস্থাপনা এবং যৌক্তিক বিশ্লেষনের কারনে প্রায়শই এ সব সেমিনারে- ওয়াকসপে তিনি আবির্ভূত হতেন মূল সঞ্চালক হিসাবে। প্রতিষ্ঠিত হতেন আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতে। গবেষনা ধর্মী লেখক হিসাবেও তার পরিচিতি ও গ্রহনযোগ্যতা ছিল।তার অনেক লেখা ও স্বাক্ষাতকার তখনকার পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারী, রোববার, সন্ধ্যা সারে ছয়টায় ঢাকার বারডেম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ৮৩ বৎসর বয়সে এই ভাষা সৈনিক ইন্তেকাল করেন। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন চার কন্যা সন্তানের জনক। আজ ২ আগস্ট মুজিবুল হকের জন্ম দিবস । দেশবাসী ও সকল আত্মীয় স্বজনদের কাছে দোয়া কামনা করেছেন স্বজনরা।
সেরা টিভি/আকিব