স্টাফ রিপোর্টার:
এ সময়ে দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত নাম পরীমনি। তিনি একজন নায়িকা। অবৈধ মাদকদ্রব্য রাখা, পর্নোগ্রাফি ও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে রাজধানীর বনানীর নিজ বাসা থেকে বুধবার রাতে তাকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
এ নায়িকার সিনেমায় অভিষেক হয় ২০১৫ সালে নজরুল ইসলাম রাজ নামের এক মাদক ব্যবসায়ীর প্রযোজনায় নির্মিত ‘সীমাহীন ভালোবাসা’ ছবি দিয়ে। এদিন তাকেও গ্রেফতার করেছে র্যাব।
সিনেমায় অভিষেকের আগে পরীমনি বিজ্ঞাপনে কাজ করতেন। টুকটাক টিভি নাটকে অভিনয় করতেন। সিনেমায় কাজ শুরুর পর তার জীবন নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। রাতারাতি হয়ে যান অগাধ টাকার মালিক। হাঁকিয়ে বেড়ান দামি গাড়ি। কীভাবে সম্ভব হলো? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে তার অতীত জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।
পরীমনির প্রকৃত নাম শামসুন্নাহার স্মৃতি। ১৯৯২ সালের ২৪ অক্টোবর সাতক্ষীরা জেলায় জন্ম তার। তার বাবা ছিলেন একজন পুলিশ কনেস্টবল। চাকরি থেকে অবসরের পর তিনি রিকন্ডিশন গাড়ির ব্যবসা করতেন বলে জানা গেছে।
২০০৭ সালের দিকে পরীমনির মা আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুর বিষয়টি অনেকটা রহস্যাবৃত। এরপর বাবার সঙ্গে সাভারে বসবাস শুরু করেন পরীমনি। মাঝে মাঝে বরিশালে নানা বাড়ি গিয়ে থাকতেন। সেখানে মাসুদ নামের দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সঙ্গে প্রেম ও পরে বিয়ে হয়। একদিন নানা বাড়ি থেকে মাসুদের সঙ্গে পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে যান। ১ মাস পর আবারও বরিশালে ফিরে আসেন। এরপর বিচ্ছেদ হয় মাসুদের সঙ্গে। ২০১১ সালের দিকে বাবার সঙ্গে সাভারের ব্যাংক টাউন এলাকায় বসবাস শুরু করেন পরীমনি। এ সময় সাভার কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। তবে নিয়মিত ক্লাস করতেন না। ২০১২ সালের শুরুর দিকে সিলেটে তার বাবার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় বলে পরীমনির ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়। ধারণা করা হয়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষ তাকে খুন করে। এরপর থেকে পরী সাভারে তার এক খালার বাসায় থাকতে শুরু করেন।
ছোটবেলা থেকেই নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন পরী। এজন্য ২০১১ সাল থেকে চেষ্টা শুরু করেন। শুরুতে বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে (বাফা) নাচ শিখতে ভর্তি হন। নাচ করতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। এভাবে সুযোগ পান টিভি নাটকে অভিনয়ের। ‘সেকেন্ড ইনিংস’, ‘এক্সক্লুসিভ’, ‘এক্সট্রা ব্যাচেলর’ নামের নাটকে দেখা গেছে তাকে। এরপর ‘নারী ও নবনীতা তোমার জন্য’ নামে একটি নাটকে নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান।
২০১৪ সালের দিকে তার সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুল ইসলাম রাজের। রাজই তাকে সিনেমায় নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। এরপর থেকে রাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে সিনেমায় নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় পরীর। ওই সময় নজরুল ইসলাম খানের পরিচালনায় ‘রানা প্লাজা’ নামের একটি ছবিতে অভিনয় করেন পরী। কিন্তু ছবিটির মুক্তি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এরপর রাজই প্রযোজক হয়ে শাহ আলম মণ্ডলের পরিচালনায় নির্মাণ করেন ‘ভালোবাসা সীমাহীন’ নামের একটি ছবি। ছবিতে নায়ক ছিলেন জায়েদ খান। এটিই পরীর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি।
সে সময়ই সিনেমাপাড়ায় তাকে নিয়ে ঘটে যায় হুলুস্থুল কাণ্ড। প্রথম ছবি মুক্তির আগেই ১৯টি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হন পরী। এরপর থেকেই শুরু হয় তার বেপরোয়া জীবন। নজরুলের সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। সেখানে প্রভাবশালীদের যাতায়াত ছিল। অভিনয় জীবন ছাড়া ব্যক্তিজীবন নিয়েও বিতর্কিত এ নায়িকা। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় পরীমনির সঙ্গে দুজনের বিয়ের খবর। এমনকি বিয়ের ছবি, কাবিননামা ও তালাকনামার ছবিও প্রকাশ পায় ফেসবুকে। ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সকালে একটি ফেসবুক আইডি থেকে কিছু ছবি শেয়ার দিয়ে দাবি করা হয়, পরীমনি ইসমাইল নামের একজনের স্ত্রী। কিছুদিন পরেই ফেসবুকে পাওয়া যায় সৌরভ কবীর নামের আরও একজনের সঙ্গে তার বিয়ের কাবিননামা এবং কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি। ছবিতে অভিষেক হওয়ার ঠিক আগের দুই বছর অর্থাৎ নাটকে অভিনয় করার সময় সেতু নামের এক ফটোগ্রাফারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তারা দুই বছর সংসারও করেছিলেন। ২০১৭ সালে তামিম হাসান নামের এক সাংবাদিকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা জানা যায়। বাগদানও হয়েছিল। তামিমকে নিয়ে প্রকাশ্যে বিভিন্ন দেশে ঘুরতেও গিয়েছেন পরী। দুই বছর প্রেমের পর ২০১৯ সালে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। সর্বশেষ অল কমিউনিটি ক্লাবে ভাঙচুরের ঘটনার দিনও তার সঙ্গে তামিমের উপস্থিতি দেখা গেছে। এদিকে তামিমের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ২০২০ সালের ৯ মার্চ রাতে অভিনেত্রী ও পরিচালক হৃদি হকের অফিসে কাজি ডেকে তার সহকারী কামরুজ্জামান রনিকে মাত্র তিন টাকা দেনমোহরে বিয়ে করেন পরী। কিন্তু সে বিয়েও ৫ মাসের মাথায় ভেঙে যায়। গত বছর এশিয়ার ১০০ ডিজিটাল তারকার তালিকা প্রকাশ করে আমেরিকার প্রখ্যাত বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বস। সেখানে জায়গা করে নেন বাংলাদেশের এ নায়িকা। কথিত আছে, প্রভাবশালীদের ক্ষমতার বলয়ে থেকে লবিংয়ের মাধ্যমে ফোর্বসে জায়গা করে নেন তিনি। ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অ্যাকটিভ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এ রকম ১০০ কণ্ঠশিল্পী, ব্যান্ডশিল্পী, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন শিল্পীকে নিয়ে তালিকাটি তৈরি করেছিল ফোর্বস।
পরী ব্যাপক ভ্রমণপিপাসু। উৎস অজানা থাকলেও বিপুল অর্থ ব্যয় করে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যেতেন। সর্বশেষ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে তাকে দেখা গেছে একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরী নিয়ে সাগরে ঘুরে বেড়াতে। সে সময় তিনি বুর্জ আল খলিফার প্রেসিডেন্ট স্যুটে ছিলেন। সেখানকার ছবি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও প্রকাশ করেন এ নায়িকা। এছাড়া ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ মামলায় পলাতক আসামি বিতর্কিত ব্যবসায়ী চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আজিজ তাকে বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার দেন বলেও জানা গেছে। এছাড়া ছবিতে অভিনয় করা কালেই তার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের এক সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। দীর্ঘদিন পরী তার ছত্রছায়ায় ছিলেন। বিভিন্ন কারণে সেই সংসদ সদস্যের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। তবে এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কিছু শিল্পপতির সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠে।
প্রথম ছবির পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন পরী। সর্বশেষ তার অভিনীত তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ‘স্ফুলিঙ্গ’ ছবিটি মুক্তি পায়। কিন্তু কোনো ছবিই ব্যবসায়িকভাবে সফলতা পায়নি। সম্প্রতি তিনি কাজ করেন সঞ্জয় সমদ্দারের ‘বায়োপিক’ ও রশিদ পলাশের ‘প্রীতিলতা’ ছবিতে। প্রতি ছবিতে তার পারিশ্রমিক ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে পারিশ্রমিকের গড় হিসাব এবং বিজ্ঞাপন অর্জিত অর্থের সঙ্গে তার জীবনযাপনের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। যেখানে অনেক নামকরা ও সুপারহিট সিনেমা উপহার দেওয়া চিত্রনায়িকা যুগের পর যুগ অভিনয় করেও উল্লেখ করার মতো অর্থবিত্তের মালিক হতে পারেননি; সেখানে পরীমনির মতো নায়িকা মাত্র অল্প কয়েক বছরে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর! ক্যারিয়ারে সাফল্যহীন একজন নায়িকার পক্ষে বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটে বসবাস এবং দামি গাড়ি কেনাসহ অল্প সময়ে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া অসম্ভব বলেই মনে করেন সংশিষ্টরা।
এদিকে শিল্পী সমিতি থেকে পরীমনির সদস্য পদ স্থাগিত হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক জায়েদ খান। তিনি বলেন, বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।
শুক্রবার (আজ) সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাব। তনি বলেন, পরীমনি যেহেতু অভিযুক্ত, তাই সমিতির রেজুলেশন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। এমনও হতে পারে, সমিতিতে তার সদস্য পদ সাময়িক স্থগিত হতে পারে। সমিতির গঠনতন্ত্রের ৬-এর ‘খ’ ও ৯-এর ‘গ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনোও সদস্য যদি সমিতির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে কোনো কাজে লিপ্ত হন সঙ্গে সঙ্গে তার সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত হবে। জায়েদ খান বলেন, আদালতে যদি প্রমাণ হয় তিনি নির্দোষ, তাহলে সদস্যপদ ফিরে পাবেন। আর যদি দোষী সাব্যস্ত হন, আজীবনের জন্য সদস্যপদ হারাবেন।
সেরা টিভি/আকিব