ভারত-বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে অনেক দিন থেকেই এবং দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির সহভাগিতা ও উত্তরণে এর ইতিবাচক ভূমিকা এবং প্রভাব অনস্বীকার্য। তারই সূত্র ধরে বিগত সময়ের ধারাবাহিকতায় এবারে সংযোজিত হচ্ছে আরেকটি নতুন প্রয়াস। এবার শুধু দুই বাংলাই নয়, স্বদেশ-প্রবাসের সেতুবন্ধনে দুই বাংলাদের দুই জনপ্রিয় বাচিক শিল্পীর এক বিশেষ উপহার, রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী সৃষ্টিশীল আবৃত্তির অ্যালবাম- ‘দোঁহে’; অংশগ্রহণে ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী অদিতি সাদিয়া রহমান এবং ভারতের জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী সত্যজিৎ বিশ্বাস, যাঁদের কণ্ঠ-নিঃসৃত শব্দ তরঙ্গে আবর্তিত হয়েছে কবিগুরুর কবিতাগুলো, বাঙময় হয়ে উঠেছে কবি গুরুর প্রেমের অমিয়ধারা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১০ টি কবিতা নিয়ে ‘রাগা মিউজিক’-এর নিবেদন ‘দোঁহে’, মুক্তি পাচ্ছে সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এর পাশাপাশি ফিজিক্যাল সিডি হবে “দোঁহে”সংকলনের। সংকলনের অধিকাংশই প্রেমের কবিতা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় কখনো প্রেমকে আলিঙ্গনে হয়েছেন তৃপ্ত, কখনো বা আড়ালে কিংবা দূরত্বে পেয়েছেন সন্তুষ্টি। কবিগুরুর প্রেম নিয়ে মনের এ খেলা উপলব্ধ অদিতি ও সত্যজিতের কণ্ঠে, তাঁদের “দোঁহে” সংকলনে। ‘দোঁহে’ -এর আবহ সঙ্গীত করেছেন ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক শ্রী কল্যাণ সেন বরাট, যা এই সংকলনকে দিয়েছে আর ভিন্ন এক মাত্রা। এ সংকলনের পরিচালনা ও পরিকল্পনায় রয়েছেন ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার আরেকজন গুণী সাংস্কৃতিক কর্মী রায়হান এলেহী, যাঁর অসাধারণ মননশীলতার ছাপ রয়েছে ‘দোঁহে’র সার্বিক পরিবেশনায়।
বাচিক শিল্পী অদিতি সাদিয়া রহমান ঢাকায় বসবাসরত অবস্থায় বিভিন্ন আবৃত্তি সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন, বহু কর্মশালায় তিনি আবৃত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। তার পরিচালনায় ঢাকার শিল্পকলায় মঞ্চস্থ “বর্ষা থেকে ফিরে এক পশলায়” আবৃত্তি অনুষ্ঠানটি বেশ প্রশংশা কুড়িয়েছিল সে সময়। ৮০-র দশকে কমিটমেন্ট প্রোডাক্ট-এর পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তি পায় তার দ্বৈত ও সহ শিল্পীদের নিয়ে আবৃত্তির সি, ডি, ‘চাঁদনিতে ভরেছে আকাশ’, ‘আমি তুমি ও মিথিলা’, এবং ‘হালুম হুলুম’। এছাড়াও ঢাকায় থাকাকালীন সময় টেলিভিশন ও মঞ্চে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন। বর্তমানে অবস্থান করছেন ওয়াশিংট্ন ডি. সি. তে। তিনি ওয়াশিংটন ডি. সি. ও নিউইয়র্কসহ দেশ-প্রবাসের অসংখ্য আন্তর্জালিক অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন।
এছাড়া ওয়াশিংটন-এ কিছু আবৃত্তিপ্রেমীদের নিয়ে গঠন করেছেন ‘সমস্বর- শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তি সংগঠন নামে একটি সংগঠন। তিনি দেশের বাইরে থেকেও নিরলস চেষ্টা করছেন আবৃত্তির অন্যতম নির্ণায়ক ‘প্রমিত ও শুদ্ধ উচ্চারণ’ সহ সকল বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে আবৃত্তি শিল্প মাধ্যমকে পূর্ণাঙ্গরূপে আবৃত্তি প্রেমীদের মাঝে উপস্থাপন করতে।
ওপর বাংলার তরুণ প্রজন্মের আরেক কৃতি এবং জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক প্রতিভা, আবৃত্তিকার সত্যজিৎ বিশ্বাস। সত্যজিৎ বিশ্বাস বহুধা প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মপ্রয়াসের মাঝে, ইতিমধ্যে তাঁর ঝুলিতে জমা হয়েছে অসংখ্য সৃষ্টির স্বাক্ষর। পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, আনন্দে মেতে উঠেছেন ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, এগিয়ে চলছেন সেই পথ ধরেই নতুন প্রজন্মের প্রেরণার উৎস হয়ে আগামীর দিকে।
পুজোর আগেই পরপর দুটি সিডি লঞ্চ হতে চলেছে সত্যজিৎ বিশ্বাসের, রাগা মিউজিক কোম্পানি থেকে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এর পাশাপাশি ফিজিক্যাল সিডি হবে দু’টোই। বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উপর রচিত কবিতা নিয়ে ওপার বাংলার বিখ্যাত আবৃত্তিশিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এপার বাংলার সামিউল ইসলাম পোলাকের সঙ্গে আবৃত্তিতে সত্যজিৎ বিশ্বাস, আর বর্তমানের এই বিশেষ প্রয়াসে আবৃত্তিতে থাকছে ওয়াশিংটন ডিসির অদিতি সাদিয়া রহমান এবং সাথে রয়েছে সবার প্রিয় ওপার বাংলার সত্যজিৎ বিশ্বাস! আর এই দুটি অ্যালবামেই কবিতার জন্য সঙ্গীত আয়োজন করেছেন শ্রী কল্যাণ সেন বরাট!
কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি রেডিও জগতের পরিচিত নাম, পরিচিত কন্ঠ সত্যজিৎ বিশ্বাস! পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবেও কিছু কাজ সত্যজিৎ করেছেন। এছাড়াও তিনি অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রে। কবিতা নিয়ে বরাবরই ব্যাতিক্রমধর্মী কাজ করেছে সত্যজিৎ! ভারতবর্ষে প্রথম বাংলা ভাষায় কবিতার চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন, “মনে রেখো”! লাইফ পেইন্টিং নিয়ে কবিতার কাজ করেছেন সত্যজিৎ বিশ্বাস, সেই কাজে ছিলেন মিস ইন্ডিয়া ইউনিভার্স খ্যাত নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়। টিভি চ্যানেলে সংবাদ পাঠ দিয়ে শুরু করে পরে সত্যজিৎ বিশ্বাস রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটেটিউ-এ সুযোগ পান বেতার সঞ্চালকের কাজের এবং এর পর জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন সংবাদ ও টিভি মাধ্যমের কাজে। রেডিও-মঞ্চ-টিভি- প্রতিটি অঙ্গনেই সত্যজিৎ বিশ্বাসের দৃপ্ত পদচারণা এবং কাজ করেছেন বহু গুনী ও বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে- শিল্পী আরতী মুখোপাধ্যায় , সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় , লিলি চক্রবর্তী, চপল ভাদুড়ি , শুভা মুদগাল, বিরজু মহারাজ, প্রদীপ ঘোষ, উর্মিমালা বসু, জগন্নাথ বসু, ব্রততী বন্দোপাধ্যায়, রত্না মিত্র,মুনমুন, নির্মলা মিশ্র , বনশ্রী সেনগুপ্ত, মাধবি মুখপাধ্যায় থেকে শ্রিকান্ত আচার্য , শুভমিতা , রুপঙ্কর,জয়তী ,ইমনচক্রবর্তী , অদিতি মুন্সি প্রমূখ। কাব্য ক্রিয়েশন নামে তৈরী করেছেন প্রডাকশন হাউস ৷ ‘ফোকজনেরা’ নামে (সহজ মা উৎপল ফকির, মাদল, দোহার ) লোকশিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন৷ কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কবিতার ভিডিও তৈরী করেছেন যেখানে সত্যজিৎ এর সঙ্গে কবিতা পড়ছেন শিমুল মুস্তাফা , সামিউল ইসলাম পোলাক, সতিনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রণতি ঠাকুরসহ মোট ১০জন আবৃত্তিশিল্পী এবং অতিমারীর কারণে অসুবিধায় থাকা শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে তৈরী করেছেন একটি স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র, যেখানে বাংলার সব প্রখ্যাত শিল্পীরা- ঋদ্ধি বন্দপাধ্যায়, মৌনিতা, গৌরব আরো অনেকে ঘরে বসেই অভিনয় করেছেন এবং সেই অনুদান তুলে দেওয়া হয়েছে অসুবিধায় থাকা শিল্পী বন্ধুদের হাতে! সত্যজিৎ পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ও করছেন এই ছবিতে ৷ সত্যজিৎ বিশ্বাস দু’টি স্বল্প দৈর্ঘের ছবিতে অভিনয় করছেন, যা প্রায় ৩০টিরও বেশি দেশে দেখানো হয়েছে এবং পুরস্কৃত হয়েছে।
অদিতি সাদিয়া রহমান এবং সত্যজিৎ বিশ্বাসের এই নান্দনিক প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে আছেন সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমীরা, তাঁদের এই প্রয়াস নতুন করে গড়ে তুলবে দেশ-প্রবাসের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের নতুন বন্ধন, অবারিত করবে সহভাগিতা দুয়ার খুলে দিয়ে এক নতুন সম্ভাবনার এবং রবীন্দ্রনাথের প্রেমের স্পর্শে, আনন্দধারায় ভরিয়ে তুলবে শ্রোতাদর্শকদের হৃদয়-মন!