ই-কমার্সের নামে লুটেরারা হাজার হাজার মানুষের টাকা হরিলুট করে এখন আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। লোভি গ্রাহক তাদের লাখ লাখ টাকা আর কোনদিন ফিরে পাবেন কিনা তার কোন নিশ্চিয়তা নেই। চিহ্নিত কিছু ই-কমার্স প্রতারক এখন কারাগারে রয়েছে। ‘প্রতারণা’র মামলায় কিছুদিন পরই জামিনে বের হয়ে তারা মানুষকে আবার পথে বসাতে পারে, নয়তো বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনলাইন টিকিটিং এজেন্সি ‘টুয়েন্টিফোর টিকেট ডটকমে’র পরিচালক মো. রফিবুল হাসানকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। তার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন বিমান টিকিট এজেন্সির ২০ কোটি আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান চুয়াডাঙ্গা থেকে তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ২০১৯ সালের মে মাসে যাত্রা শুরু করে অনলাইন টিকিটিং এজেন্সি ‘২৪ টিকেট ডটকম’। মহাখালী ডিওএইচএস-এ জমকালো অনুষ্ঠানে এর প্রধান কার্যালয় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব।
তখন তারা জানিয়েছিল, বিডি টুরিস্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। বিডি টুরিস্টেরও একক মালিকানায় রয়েছেন মো. আব্দুর রাজ্জাক। প্রতিষ্ঠানটির সিইও প্রদ্যোতবরণ চৌধুরী গত ডিসেম্বরে দুবাই চলে যান। গত মে মাসে লাপাত্তা হয়ে যায় অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি। প্রাথমিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
ই-কমার্স কোম্পানি ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জ, নিরাপদ ডটকম, কিউকম ও এসপিসি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা হয়েছে। গত মে মাসে ‘টিকেট ২৪ ডটকমে’র বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় একটি জিডি করেন ২০ ভুক্তভোগী প্রবাসী। এছাড়াও আইকন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মো. ইব্রাহিম নামে এক ব্যক্তিও প্রতারণার অভিযোগে জিডি করেন।
সিআইডি জানায়, রফিবুল হাসানের বিরুদ্ধে ৩ অক্টোবর উত্তরা পশ্চিম থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়েছে। উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলাটি করেন মো. মুসা মিয়া সাগর নামে এক ব্যক্তি। মামলায় আসামি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক সিইও প্রদ্যোত বরণ চৌধুরী, মো. রাকিবুল হাসান, পরিচালক (ফিন্যান্স) মো. আসাদুল ইসলাম, এম. মিজানুর রহমান সোহেল, রাজ্জাকের বোন মোসা. নাসরিন সুলতানার নাম উল্লেখ ও ১০-১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
এদিকে গুলশানের আরেক ই-কমার্স ‘আনন্দের বাজার’ গ্রাহকের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে বলে জানা যায়। গুলশানের জব্বার টাওয়ারের ১৩ তলায় এর অফিস খোলা হয়। নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ ছাড়ে প্রলোভন দেখিয়ে মোটরসাইকেল, মুঠোফোনসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করতে শুরু করে। ৩০ কর্মদিবসের মধ্য কিছু গ্রাহকের কাছে পণ্য সরবরাহ করে আস্থা অর্জনের পর লোভি গ্রাহকদের টাকা নিয়ে ফাঁদে ফেলে তারা উধাও হয়ে যায়।
কোম্পানির এক গ্রাহক এম এ হোসাইন গণমাধ্যমকে জানান, ৩০ শতাংশ ছাড়ে গত ১৮ আগস্ট ৮ লাখ ৮ হাজার টাকায় তিনটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলেন তিনি। গত মাসের ২৬ তারিখে মোটরসাইকেলগুলো পাওয়ার কথা ছিল। যোগাযোগ করলে চেক দেওয়া হয়। দু-তিনটি ব্যাংকে ঘুরেও টাকা তুলতে পারেননি।
আফসার নামে আরেকজন একটি মোটরসাইকেল এবং ৮০টি মুঠোফোন কেনার জন্য ‘আনন্দের বাজারে’ অর্ডার দিয়েছিলেন। গত দেড় মাস আগে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা জমা দেন। কিন্তু সময়মতো পণ্য না পেয়ে তিনি কোম্পানির কার্যালয়ে এসে যোগাযোগ করেন। তাঁকে ঘোরাচ্ছিলেন কোম্পানির কর্মকর্তারা। পরে একটি চেক দেওয়া হয়। কিন্তু সেই চেকে টাকা পাচ্ছে না। আনন্দের বাজারের এমডি আহমুদুল হক খন্দকারকে কোথাও পাওয়া যায়নি।
পুলিশ সূত্র জানায়, আনন্দের বাজারের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একজন গ্রাহক প্রতারণার অভিযোগে মামলা করতে এসে জানান, অফিস বন্ধ করে কোম্পানির লোকজন পালিয়ে গেছে। এরপর দুপুরে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বজলুর রশিদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল জব্বার টাওয়ারে যায়। পুলিশ আনন্দের বাজারের কার্যালয়ের তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে দেখতে পায় মেঝেতে কিছু কাগজ ও ফাইল পড়ে ছিল। প্রায় ৫০টির মতো কম্পিউটার টেবিল ও চেয়ার থাকলেও কোনো কম্পিউটার ছিল না।
আসবাবও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এসআই বজলুর রশিদ জানান, এই কোম্পানির কত গ্রাহক, কত টাকার ব্যবসা, কত টাকা আটকে আছে, মামলার পর তদন্ত শেষে তা জানা যাবে।
ই-কমার্স কোম্পানি ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জ, নিরাপদ ডটকম, কিউকম ও এসপিসি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রাহকের পাওনা না দেওয়া ও অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ওই সকল কোম্পানি অন্তত ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এই ৬টিসহ মোট ১২টি ই-কমার্স কোম্পানি গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না।
বহুল আলোচিত রিং আইডির পরিচালক সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২৩১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত শুক্রবার গুলশান থেকে গ্রেপ্তার পর তাকে আদালত কারাগারে পাঠান।
ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির এমডি মো. রাসেল ও তাঁর স্ত্রী শামীমা নাসরিন এখন কারাগারে। ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান এবং সিওও আমানউল্লাহও এখন জেলে। ভারতে পালিয়ে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন ই-অরেঞ্জের মূল মালিক বলে পরিচিত পুলিশের পরিদর্শক সোহেল রানা। পরিকল্পিত প্রতারকদের বিছানো জালে আটকা পড়ে অর্থ লোভি গ্রাহকদের অবস্থা এখন ত্রাহিত্রাহি।