অনলাইন ডেস্ক:
ইসরাইলের গোয়েন্দা নজরদারিকারী ও আড়িপাতার যন্ত্র পেগাসাস প্রস্তুতকারক এনএসও গ্রুপকে কালো তালিকাভুক্ত করে তার বিরুদ্ধে অবরোধ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। বলা হয়েছে, এই কোম্পানির স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে নিষ্পেষণ চালানোতে সহায়তা করা হয়েছে। তা ব্যবহার করে টার্গেট করা হয়েছে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের। বলা হয়েছে, এই কোম্পানি প্রযুক্তি তৈরি করে স্পাইওয়্যার বিদেশি সরকারগুলোকে সরবরাহ দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এই হাতিয়ারকে ব্যবহার করেছে অসৎ উদ্দেশে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা।
বুধবার এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকা-ের বিরোধী বলে মনে করা হয়েছে এমন চারটি প্রতিষ্ঠানকে রাখা হয়েছে ‘এনটিটি লিস্টে’। তার মধ্যে অন্যতম এনএসও গ্রুপ।
এতে ইসরাইলের আরো একটি গ্রুপের নাম আছে। এখানে উল্লেখ্য, বিশ্বজুড়ে এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা দেয় মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলোর। কারণ, এ বছরেই আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো এক তদন্তে দেখতে পায় যে, বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার ও তার নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে। তারা এসব ব্যবহার করে বিরোধী রাজনীতিক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির তথ্য চুরি করে। এ ঘটনায় সারা বিশ্ব তোলপাড় হয।
এনএসও গ্রুপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এনটিটি লিস্টে ইসরাইলের আরো একটি প্রতিষ্ঠান আছে ক্যান্ডিরু। এতে আরো আছে রাশিয়াভিত্তিক পজেটিভ টেকনোলজিস এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ কনসালট্যান্সি পিটিই লিমিটেডে। তাদের উদ্ভাবিত স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে এক দেশের সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিষ্পেষণ চালাতে সক্ষম। আর এটা হলো দেশের বাইরেও ভিন্ন মতাবলম্বী, সাংবাদিক এবং অধিকারকর্মীদের কণ্ঠকে নিভিয়ে দিতে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের আচরণ। এ কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে আরো বলা হয়েছে, সরকারগুলোর এমন চর্চা আইনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক যে শৃংখলা আছে, তার প্রতি হুমকি।
জবাবে এনএসও গ্রুপ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তে তারা হতাশ। এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। কোম্পানিটির এক মুখপাত্র বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা কিভাবে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার বিষয়ক কর্মসূচিকে মেনে চলি সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য উপস্থাপন করবো। আমাদের এসব কর্মসূচি গভীরভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধের ভিত্তিতে। যেসব সরকার আমাদের প্রোডাক্টের অপব্যবহার করেছে, এমন বহু সরকারের সঙ্গে আমরা এরই মধ্যে চুক্তি বাতিল করেছি।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক অ্যালান ফিশার বলছেন, এই কোম্পানিগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করার ফলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রযুক্তি আমদানি করতে পারবে না। তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি, যন্ত্রাংশ দিয়ে এসব তৈরি করে। অন্য দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের এসব প্রযুক্তি আমদানি করার অধিকার পাবে না। কারণ, তাদেরকে এই সুযোগ দেয়া হলে তাদের মাধ্যমে এসব যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি সংগ্রহ করবে ইসরাইল ও সংশ্লিষ্টরা।
ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর দ্য সিটিজেন ল্যাব ইসরাইলের এনএসও গ্রুপের পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার নিয়ে বহু রিপোর্ট করেছে। এর সিনিয়র গবেষক জন স্কট-রেইলটন টুইটারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্ত ইসরাইলি এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি বড় ধরনের আঘাত। এর ফলে এনএসও গ্রুপের ব্যবসা এবং কোম্পানির ওপর তাৎক্ষণিক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নাটকীয়ভাবে এক শীতল প্রভাব পড়বে। এনএসও গ্রুপের ওপর পড়বে ভবিষ্যত দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব।
অন্যদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল টেকনোলজির উপপরিচালক ডানা ইঙ্গেলটন বলেছেন, কালো তালিকাভুক্তকরণ এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে এক কঠিন বার্তা দেবে। তা হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো নিষ্পেষণ চালানো ছাড়া আর লাভবান হতে পারবে না। এনএসও গ্রুপের বিনিয়োগকারীদের জন্যও এটা হিসাব নিকাশ করে দেখার দিন। তাদেরকে হিসাব কষে দেখতে হবে যে, যে কোম্পানি পর্যায়ক্রমিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রযুক্তি তৈরি করে যায়, সেখানে তাদের বিনিয়োগ অব্যাহত রাখা উচিত কিনা।
বছরের পর বছর সমালোচনার শিকার হলেও কোনো অন্যায় করার কথা বার বার প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছে এনএসও গ্রুপ। তারা যুক্তি দিচ্ছে, তাদের এই প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে ক্রিমিনাল এবং সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করতে। এ বছরের শুরুর দিকে পেগাসাস পেপার নামে যে তদন্ত রিপোর্ট বের হয় তাকেও তারা প্রত্যাখ্যান করে। এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ বিভিন্ন দেশ। কিন্তু এসব দেশ এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
জুলাইয়ে এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে অবরোধ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন বেশ কিছু ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতা। যৌথ এক বিবৃতিতে কংগ্রেস সদস্যরা বলেন, মুক্তবাজারে সাইবার-নজরদারি বিষয়ক স্পর্শকাতর যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ বিক্রি করা উচিত নয় বেসরকারি কোম্পানিগুলোর। এই বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রিত করতে মিত্রদের সঙ্গে কাজ করা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। পক্ষান্তরে ইসরাইলের সমালোচনাকে প্রকাশ্যে এড়িয়ে গেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার শীর্ষ সহযোগীরা। কিন্তু সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে হুঁশিয়ারি দেন বাইডেন। নিষ্পেষণকে গভীর করে এমন উদীয়মান প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
এনএসও গ্রুপ ইসরাইলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো ইসরাইল সরকারের কড়া সমালোচনা করে। তাদের অভিযোগ এই কোম্পানিকে স্পাইওয়্যার রপ্তানির লাইসেন্স দিয়েছে সরকার।
বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আরো বলা হয়, যে অবরোধ দেয়া হয়েছে তা রাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রভাবিত করবে না। কারণ, যেসব দেশে এসব প্রতিষ্ঠান অবস্থিত আমরা সেইসব দেশ বা সরকারগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন, এমন সব ঘটনার ক্ষেত্রে অংশীদার সরকারকে আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে তাই হয়েছে।
সেরা টিভি/আকিব