ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক:
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে প্রাণে বাঁচতে সুরক্ষা বলয় তৈরিতে নিমগ্ন ছিলেন তারা। দেশি-বিদেশি, নাগরিক-পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট (পিআর), শিক্ষার্থী কিংবা সামান্য মাইনের অস্থায়ী চাকুরে- সবাই ছিলেন এক কাতারে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইটা ছিল সম্মিলিত-সমন্বিত। বিপদের মুহুর্তে এমনটাই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু আচমকা অস্ট্রেলিয়ার সরকার প্রধানের এক ঘোষণায় বিদেশি শিক্ষার্থী ও হলিডে ওয়ার্কার মাথায় কার্যত আকাশ ভেঙ্গে পড়ে!
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন কোনো রকম রাখঢাক না করেই বলেন, সরি, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, কঠিন এই সময়ে আমরা আমাদের নাগরিকদের নিয়ে নজর দিতে চাই। কোভিড-১৯ এর এই দুর্যোগে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ছাড়া আর কারো দায়িত্ব নিতে পারছে না সরকার। ফলে এ দেশে যারা অস্থায়ী ভিসা নিয়ে আছেন এবং খরচ নির্বাহের সামর্থ্য নেই, তাঁদের বিকল্প হচ্ছে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া। বিদেশি শিক্ষার্থী যারা চিকিতসা বিজ্ঞান কিংবা নার্সিং পড়ছেন না তাদেরকেও আমরা উতসাহিত করছি ফিরে যেতে।
স্কট মরিসন এ-ও বলেন, জন্ম যার যে দেশেই হোক, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলে তার সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের।
সরকারকে অবশ্যই নাগরিক এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের সর্বাধিক অর্থনৈতিক সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান, বাংলাদেশ মিশন এবং লোকাল কমিউনিটির তথ্য মতে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নত ওই দ্বীপ রাষ্ট্রে বর্তমানে ৫ লাখেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীসহ প্রায় ২০ লাখ অস্থায়ী ভিসাধারী রয়েছেন। ওই দেশে বাংলাদেশ নামক আজকের স্বাধীন ভূখন্ডের মানুষজনের বসবাসের ইতিহাস শত বছরের। ২০১১ সালের সর্বশেষ গণ-জরীপে অস্ট্রেলিয়ায় ৫২,৯২০ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্থায়ীভাবে বাসবাসের তথ্য রেকর্ডভুক্ত হয়। তবে এই ক’বছরে সেই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন হয়েছে মর্মে তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশিদের বাস প্রধানত নিউ সাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া প্রদেশে, মেলবোর্ন ও সিডনিতে। তবে বিশাল ওই দেশে অন্য এলাকাতেও এখন বাংলাদশিদের সংখ্যা অপ্রতুল নয়। দেশটিতে এখন তৃতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশিদের অবস্থান বেশ পোক্ত। তবে সেখানে অবস্থারত বাংলাদেশিদের প্রায় এক দশমাংশ রয়েছেন পড়াশোনা এবং স্বল্পকালীন চাকুরি নিয়ে। প্রকৃত হিসাব কারও কাছেই নেই এমন দাবি করে ক্যানবেরার বাংলাদেশ হাই কমিশন এবং নব প্রতিষ্ঠিত সিডনি কনস্যুলেটের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে-
প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের শুক্রবারের ঘোষণায় এটা স্পষ্ট যে অস্ট্রেলিয়া সরকার চাইছে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী যাদের সাপোর্ট নাই এবং যারা হলিডে ওয়ার্কার (এখন বেকার) তারা ফিরে যাক। বিশাল অস্ট্রেলিয়াজুড়ে এমন বাংলাদেশির সংখ্যা কত হতে পারে? সেই প্রশ্নে বাংলাদেশি কূটনীতিকরা ধারণা দেন- এটি ১০ হাজারের মতো হবে। তারা বিভাজনটি করেছেন এভাবে- স্টুডেন্ট ৫ থেকে ৬ হাজার, হলিডে ওয়ার্কার বা পার্টটাইমার ২-৩ হাজার এবং পিআর বা নাগরিকত্বের আবেদন ঝুলে থাকা বাংলাদেশি দেড় থেকে দুই হাজার।
হাইকমিশনার সুফিউর রহমান জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সরকার প্রধানের ঘোষণাই নয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে শনিবার। কূটনৈতিক মিশনগুলোতে পাঠানো ওই নোটে করোনা সঙ্কট বিষয়ে মন্ত্রীসভার বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলোর বিস্তারিত জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশি ওই জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক খোলাসা করে সব কিছু না বললেও কর্মনির্ভর বিদেশি শিক্ষার্থী যাদের যথেষ্ট সঞ্চয় নেই তারা যে এরইমধ্যে সমস্যায় নিমজ্জিত সেই আভাস পাওয়া যায় তার কথায়। এটি আরও স্পষ্ট হয় সিডনির বাংলাদেশ কমিউনিটিতে কথা বলে। জানা যায়, সেখানে ইতোমধ্যে করোনার পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কাজ কর্মহীন বাংলাদেশিদের জন্য কমিউনিটি অবশ্য এগিয়ে এসেছে।
সিডনীর নার্গিস কাবাবে রান্না আর খুশবু হোটেলে প্রতিদিন ৩ থেকে সাড়ে ৩ শ বাংলাদেশি স্টুডেন্টের জন্য ফ্রি লাঞ্চ এবং ডিনারের আয়োজন চলছে। শুধু তাই নয়, অস্ট্রেলিয়া সরকার মোটামুটি ৩ মাসের একটি সেমি লকডাউনে গেছে। পুরো সময়ই সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে কর্মহীন বাংলাদেশি এবং কর্মনির্ভর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের লাঞ্চ-ডিনারের এ আয়োজন থাকছে। এছাড়া ওয়েল এনাফ বাংলাদেশ কমিউনিটির সদস্যরা নীরবে তাদের অন্যান্য সহযোগিতাও করছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠেছে- এভাবে কতদিন?
অস্ট্রেলিয়া সরকার যদি বিদেশিদের খেদাও এর ঘোষণা বাস্তবায়নে আরও কঠোর হয় তাহলে কয়েক হাজার বাংলাদেশিকে ফিরতেই হবে। বাংলাদেশ মিশন সূত্র জানিয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে কর্মহীন বাংলাদেশি, অস্থায়ী ভিসাধারী এবং স্বল্প মেয়াদি স্টুডেন্ট ভিসায় যাওয়া কর্মনির্ভর বিদেশি শিক্ষার্থীদের (কম খরচে) স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার সূযোগ দিতে কয়েকটি ফ্লাইট ওপেন করতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। বর্তমানে ইনকামিং আউটগোয়িং সব ফ্লাইট বন্ধ।
মূলত কয়েটি দেশ থেকে আটকেপড়া অস্ট্রেলিয়ানদের ফেরানো এবং সেই সূযোগে বিদেশি কর্মনির্ভর স্টুডেন্টদের বের হয়ে যেতে কূটনৈতিক চ্যানেলে বার্তা স্পষ্ট করা হয়েছে। যদিও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বা কেবিনেটের ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন ওঠেছে। বলা হয়েছে- সোশ্যাল সেফটি বা সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা আগেও পেতেন না বিদেশিরা। কিন্তু তারপরও ওই সুরক্ষার দোহাই তুলে তাদের বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো, যা দু:খজনক।
তাছাড়া সিদ্ধান্তটি এমন সময় এলো- যখন দুনিয়ার ২০৬টি দেশ এক এবং অভিন্ন সঙ্কটে নিপতিত। আর এই অমানবিক সিদ্ধান্তটি নিলো অস্ট্রেলিয়ায় মতো মানবাধিকার সংবেদনশীল একটি রাষ্ট্র। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের মতো আসা অস্ট্রেলিয়া প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের ওই ঘোষণায় মিশ্র হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। সমালোচনাই বেশি হচ্ছে। তবে অতিমাত্রায় জাতীয়তাবাদীরা সরকারের প্রশংসাই করেছেন। কিন্তু সমালোচনার কারণে সরকারি ওই ঘোষণা বা সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসতে পারে, এমনটা কেউই মনে করছেন না বরং এটি কার্যকর হবে এবং বাংলাদেশিসহ বিদেশিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের অস্ট্রেলিয়া ত্যাগ করতে হবে এটি মানছেন অনেকে।
তবে নার্সিং বিষয়ে পড়ুয়াদের এখন কদর বাড়বে। কারণ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া সরকার সব প্রাইভেট হাসপাতাল এবং পাঁচতারকা অনেক হোটেলকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে এসেছে। অস্থায়ী ওই সব মেডিকেলে প্রচুর চিকিৎসক ও নার্স প্রয়োজন।
অন্যদিকে, যারা হলিডে ওয়ার্কিং ভিসায় ফল ও সবজি বাগানে কাজ করেন, তাদের ভিসার মেয়াদ বাড়ছে।
অস্ট্রেলিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী মাইকেল মাসিকর্মাক জানিয়েছেন- কঠিন ওই মুহূর্তে তাদের প্রচুর ফল ও সবজি প্রয়োজন। তাই এ খাতে কোনো ছুটি বা ছাঁটাই নেই।
ক্ষোভ প্রতিবাদ:
তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে দ্য কাউন্সিল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অস্ট্রেলিয়া নামের সংগঠন। তারা বলছে, অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের বিরাট ভূমিকা আছে। একজন ছাত্র গড়ে ৪০ হাজার ডলার টিউশন ফি দিয়ে থাকেন। প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সরকার ৩২ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী স্কট বর্ণবাদী বক্তব্য রেখেছেন এবং তিনি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছেন। এখন অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ সীমান্ত বন্ধ। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ লকডাউনে। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া সরকারের এই ঘোষণা অমানবিক।
সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা: ওদিকে সরকারী ওই কঠিন সিদ্ধান্তের পক্ষেও নানান যুক্তি দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে- অস্থায়ী ভিসায় ব্যাকপ্যাকাররা যে শেয়ারহাউস ও ভূগর্ভস্থ হোস্টেলগুলোতে থাকেন, সেগুলো অধিক জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়া সরকার অপরিহার্য নয় এমন পরিষেবা বন্ধ করলেও বিদেশিদের থাকার এ স্থানগুলো এখনও বন্ধ করতে পারছে না।
উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়া সরকারে কঠোর পদক্ষেপের মধ্যেও দেশটিতে দ্রুত করোনা সংক্রমণ হচ্ছে। রোববার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৬ ‘শ ৮৭ জন। এর মধ্যে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে খুশির খবর হচ্ছে এরইমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ২ হাজার ৩ ‘শ ১৫ জন। তবে খুবই আশার দিক হচ্ছে রোববার রাতে (এ রিপোর্ট লেখা) পর্যন্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো অস্ট্রেলিয়ান বা অস্থায়ী ভিসায় দেশটিতে থাকা কোনো বাংলাদেশির করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেনি।
সেরা নিউজ/আকিব