সেরা নিউজ ডেস্ক:
ভেঙ্গে গেছে মহামারির নিরবতা। উবে গেছে সামাজিক দূরত্বের সব বিধিনিষেধ। হঠাৎই উত্তাল গোটা আমেরিকা। একটানা বিক্ষোভ চলছে বিভিন্ন বড় শহরে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কোথাও কোথাও মোতায়েন করা হয়েছে ন্যাশনাল গার্ড। শুক্রবার দিনভর তো বটেই, দিবাগত রাতভরও বিক্ষোভ চলেছে আমেরিকাজুড়ে। বেশ কয়েকটি শহরে রাতের বেলায় বেড়েছে বিক্ষোভের বিস্তৃতি। খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসের সামনে একটানা গণবিক্ষোভ চলছে।
রাত সাড়ে ১২টায় এই রিপোর্ট লেখার সময়ও সেখানকার দৃশ্য ছিল টালমাটাল। আর যে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের হত্যাকান্ডকে ঘিরে বিক্ষোভের উত্তাল আমেরিকা সেই হতভাগ্য জর্জ ফ্লয়েডের নিজের শহর মিনেয়াপলিস বিক্ষোভের আগুনে রীতিমতো জ্বলছে। মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের প্রধান এই শহরটিতে গত তিনদিন ধরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে বিরামহীনভাবে। শুক্রবার সেই বিক্ষোভ চুড়ান্ত রুপ নেয়। এদিনে সেখানে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে পুলিশ স্টেশনসহ বহু স্থাপনা। এছাড়া নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস ও আটলান্টাসহ আরও বহু শহরে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-উত্তরাঞ্চলীয় স্টেট মিনেসোটার প্রধান শহর মিনেয়াপলিসে গত সোমবার পুলিশের নির্যাতনে নিহত হন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড। পরদিন মঙ্গলবার তার হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। গা শিউরে ওঠা সেই দৃশ্যটির ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায় অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে। আর তাতেই শুরু হয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চাউভিন ও তার তিন সঙ্গীকে প্রথমে কেবল চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর বিক্ষোভের তীব্রতার মুখে শুক্রবার ডেরেককে প্রথমে গ্রেফতার করা হয় এবং পরে তার বিরুদ্ধে থার্ড ডিগ্রি মার্ডারের (সরাসরি হত্যাকাণ্ড) অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু ততক্ষণে বিক্ষোভকারীরা সেই পুলিশ স্টেশনটি জ্বালিয়ে দেয় যেখানে কাজ করতেন ডেরেক চাউভিন। মিনেসোটার গভর্ণর টিম ওয়ালজ এবং মিনেয়াপলিসের মেয়র জ্যাকব ফ্রে দিনভর দফায় দফায় বিক্ষুদ্ধ জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। তারা অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গৃহীত আইনী পদক্ষেপের কথা জানিয়ে জনগণকে শান্ত হওয়ার আহবান জানান। কিন্তু তাতেও বিক্ষোভের আগুনে পানি পড়েনি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ডাকা হয় ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীকে। তাদের উপস্থিতি উল্টো বিক্ষোভকারীদের আরও উত্তেজিত করে তোলে। আর প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য বিক্ষোভের আগুনে রীতিমতো ঘি ঢেলে দেয়। বিভিন্ন শহরের বিক্ষোভকারীরা প্রায় অভিন্ন ভাষায় অভিযোগ করতে থাকেন যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উষ্কানীমূলক আচরণ ও বক্তব্যের কারণেই আমেরিকাজুড়ে বর্ণবাদী হিংস্রতা বেড়ে চলেছে। শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্য বর্ণের মানুষেরা নির্যাতিত, এমনকি হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হচ্ছে।
এর আগে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যকাণ্ডের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে যথাযথ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে এফবিআই ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের প্রতি আহবান জানালেও শুক্রবার দুপুরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিক্ষোভকারীদের দস্যু (Thugs) অভিহিত করে বলেন, ”লুটতরাজ শুরু তো গুলিও শুরু”। আমেরিকায় বর্ণবাদী অত্যাচারের ইতিহাসে এটি অনেক পুরোনো একটি কথা, যা ১৯৬০ সালে কৃষ্ণঙ্গদের ওপর নির্যাতনের অজুহাত হিসাবে বলেছিলেন মায়ামি’র তৎকালীন পুলিশ প্রধান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই কথার প্রতিক্রিয়ায় সর্বত্র বিক্ষোভ মারাত্মক উত্তেজনাকর হয়ে উঠে এবং নতুন নতুন শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই শুক্রবার অপরাহ্নে প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে জানানো হয় যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফ্লয়েডের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেছেন এবং মর্মান্তিক এই ঘটনায় পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। অপরদিকে আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী এবং সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও জর্জ ফ্লয়েডের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে নিজেই সিএনএন টেলিভিশনকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সেই হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়া শব্দগুলো ‘ আই কান্ট ব্রিদ’ আমরা যেমন শুনেছি, তার পরিবারের সদস্যরাও শুনেছে। এখানে সান্তনা দেয়ার কিছু নেই। তিনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একইসঙ্গে গভীর শোক এবং ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, আমরা আর একজন আমেরিকানের ওপরও এ ধরণের বর্ণবাদী হিংস্রতা দেখতে চাই না।
প্রতিটি আমেরিকানদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গীকারই আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আমেরিকার যেসব শহরে ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ চলতে থাকে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মিনেসোটা স্টেটের মিনেয়াপলিস ও সেন্ট পল, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের লস অ্যাঞ্জেলেস, বেকার্সফিল্ড, স্যাক্রামেন্টো, সান হোসে, অকল্যান্ড ও সানফ্রান্সিসকো, কলোরাডো স্টেটের ডেনভার, জর্জিয়া স্টেটের আটলান্টা, ইলিনয় স্টেটের শিকাগো, আইওয়া স্টেটের ডেস ময়েনস, ইন্ডিয়ানা স্টেটের ইন্ডিয়ানাপলিস ও ফোর্ট ওয়েন, কেন্টাকি স্টেটের লুইসভিল, লুইজিয়ানা স্টেটের নিউ অরলিন্স, ম্যাসাচুসেটস স্টেটের বস্টন, মিশিগান স্টেটের ডেট্টয়েট, নেভাডা স্টেটের লাসভেগাস, নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেটের শার্লট, ওহাইয়ো স্টেটের কলম্বাস ও সিনসিনাটি, টেক্সাস স্টেটের ডালাস ও হিউস্টন, ভার্জিনিয়া স্টেটের রিচমন্ড, নিউ ইয়র্ক স্টেটের নিউ ইয়র্ক সিটি এবং আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি।
ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও বহু মানুষ আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যও আছেন। এছাড়া গ্রেফতার করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক বিক্ষোভকারীকে। নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন বার্কলে সেন্টার এলাকায় গ্রেফতার করা হয় দুই শতাধিক বিক্ষোভকারীকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বিভিন্ন শহরে জলকামান, পিপার স্প্রে, কাঁদুনে গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করেছে। বিক্ষোভকারীরাও পুলিশের দিকে ইট-পাথরের টুকরোসহ বিভিন্ন বস্তু ছুঁড়ে মারে। আটলান্টায় বিক্ষোভের সময় টেলিভিশন নেটওয়ার্ক সিএনএন এর প্রধান কার্যকালয়ে হামলার ঘটনাও ঘটে। এছাড়া মিনেয়াপলিসে সরাসরি বিক্ষোভের সংবাদ পরিবেশনের সময় পুলিশ দৃশ্যত কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ সিএনএন এর সাংবাদিক ওমর জিমেন্জকে হঠাৎ আটক করে নিয়ে যায়। অবশ্য কিছু সময় পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং মিনেসোটার গভর্ণর টিম ওয়ালজ এই ঘটনায় সাংবাদিক ওমর, সিএনএন কর্তৃপক্ষ এবং সকল সাংবাদিকের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেন।
হত্যাকারীর সঙ্গে বিচ্ছেদ চেয়ে স্ত্রীর মামলা
এদিকে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গোটা আমেরিকা যখন বিক্ষোভে উত্তাল ঠিক সেই সময় হত্যাকারী পুলিশ অফিসার ডেরেক চাউভিনের স্ত্রী কেলি চাউভিন স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ চেয়ে মামলা করেছেন। কেলির পক্ষে তার আইনী প্রতিষ্ঠান সেকুলা ফ্যামিলি ল অফিস শুক্রবার রাত ১২টার কিছু আগে গণমাধ্যমকে এই খবর জানায়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, শুক্রবার সন্ধ্যায় কেলি চাউভিন ও তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কেলি খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন এবং তিনি এই মর্মান্তিক ঘটনায় ফ্লয়েডের পরিবারের সঙ্গে, তার ভালবাসার মানুষদের সঙ্গে সমব্যাথি। আর সেই প্রেক্ষিতেই তিনি ডেরেকের সঙ্গে বিচ্ছেদ চেয়ে আবেদন করেছেন। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ডেরেকের সংসারে কেলির কোনো সন্তান নেই। তবে তিনি বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ জানিয়েছেন যে, তার আগের সংসারের সন্তানগণ এবং বৃদ্ধ পিতামাতাসহ পরিবারের অন্যসবাই যেন এই কঠিন সময়ে নিরাপদ থাকেন।
সেরা নিউজ/আকিব