ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক:
লিবিয়ার মরুভূমিতে এখনো বহু বাংলাদেশি রয়েছেন, যারা ইতালি যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায়! বিশাল মরুভূমিতে কমপক্ষে ৩টি গ্রুপে শতাধিক বাংলাদেশি থাকার প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে ত্রিপলিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। এ নিয়ে সেগুনবাগিচাও ওয়াকিবহাল। তবে রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলী বলছেন, যুদ্ধকবলিত লিবিয়া মানবপাচারের তুলনামূলক নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু দিন ধরে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এবং স্থানীয় সূত্রে বিভিন্ন সময় বিভিন্নরকম তথ্য পাওয়া যায়। দূতাবাস তা যাচাই করে। ওই তথ্য কোন একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা তথ্যটা খতিয়ে দেখছি, তবে এখনও নিশ্চিত বা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। সঙ্গে আলাপে সোমবার রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি অন্য একটি অফিস্যিয়াল কাজে ত্রিপলির বাইরে আছি, স্টেশনে ফিরলে এ বিষয়ে হয়তো আরও কিছু তথ্য দিতে পারবো।
এদিকে দূতাবাসের শ্রমবিভাগ সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে মরুভূমি সংলগ্ন মিজদাহ শহরের একটি স্মাগলিং ওয়্যারহাউজে ২৬ বাংলাদেশিকে ব্রাশফায়ারে হত্যার পর স্থানীয় সোর্স মারফত আরও অন্তত ৩ টি ওয়্যার হাউজে অভিবাসীদের বন্দি করে রাখার তথ্য মিলেছে। সব গ্রুপেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছেন মর্মে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
স্মাগলিং ওয়্যার হাউজে বন্দি কিছু বাংলাদেশির ছবিও দূতাবাস কর্মকর্তাদের হস্তগত হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রাপ্ত তথ্য এবং ছবিগুলোর মিল-অমিল এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লোকেশনও মিলিয়ে নেয়ার কাজ চলছে। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে কত বাংলাদেশি রয়েছে তার তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, তবে এটা নিশ্চিত যে সেখানে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন।
উদ্ধার করা না গেলে এদের বেশিরভাগেই হয় মরুভূমিতে না হয় সাগরে সমাধি হবে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, চেষ্টা চলছে তাদের লোকেশন ট্রেস করার। এটি করা গেলে হয়তো উদ্ধারও করা যাবে। দেখা যাক কি হয়!
আহতদের দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গত ২৮ শে মে মিজদাহতে মানবপাচারকারী ও মিলিশিয়াদের যৌথ হামলায় গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যাওয়া ১১ বাংলাদেশির মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলী। এর মধ্যে একজনের মাথায় গুলি লেগেছে। দুজনেরই অপারেশ হয়েছে। ত্রিপলির একটি হাসপাতালের আইসিইউতে তাদের চিকিৎসা চলছে। হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া একজন আহত বাংলাদেশি নাগরিকের বয়ানের ভিত্তিতে লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম বিষয়ক কাউন্সিলর আশরাফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছেন।
একই সঙ্গে ওই পথে তাদের যাওয়ার প্রেক্ষাপটও বর্ণনা করেছেন। তার দেয়া তথ্য মতে, মারা যাওয়া ২৬ জনসহ মোট ৩৮ জন বাংলাদেশি ও কিছু সুদানি সেখানে ছিলেন। রাজধানী ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদায় তাদের আটক করে রাখা হয়েছিল তাদের। মূলত: ইতালিতে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে ওই ৩৮ জন বাংলাদেশি লিবিয়ায় গিয়েছিলেন বলে জানান আশরাফুল ইসলাম।
তার দাবি করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জটিলতা শুরু হওয়ার আগে ডিসেম্বর মাসে তারা ভারত ও দুবাই হয়ে বেনগাজি বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর গত কয়েক মাস তাদেরকে লিবিয়ার ভেতরে গোপনে রাখা হয়েছিল। উপকূলীয় অঞ্চল যুওয়ারা হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসীদের নিয়ে ইতালির দিকে যাত্রা করার পরিকল্পনা ছিল পাচারকারীদের। লিবিয়ায় নানা মত ও পথের অসংখ্য সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী তৎপর রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বছরের এই সময়টায় সাগর অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকায় এটিকেই সাগর পাড়ি দেয়ার আদর্শ সময় বলে মনে করে পাচারকারী চক্র।
প্রাণহানীর ঝুঁকি জেনেও ইতালির মোহে বাংলাদেশিদের যাত্রা: এদিকে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র এবং ঢাকার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা বলেন, প্রাণহানীর আশঙ্কার কথা জেনেও বাংলাদেশিরা বিপদসংকুল লিবিয়ার পথে পা বাড়ান কেবলই ইউরাপ যাওয়ার নেশায়। পালের মো প্রটোকলে মতে এমন কর্ম হিউম্যান ট্রাফিকিং নয় বরং স্মাগলিং। স্মাগলাররা একজন বাংলাদেশিকে লিবিয়া পৌঁছাতে কমপক্ষে চারবার হাত বদল করে। এবং পুরো কাজটি হয় জঙ্গী স্টাইল বা কাট-আউট সিস্টেমে। অর্থাৎ খুব কম সময়ই এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের তথ্য জানে। এটাকে অনেকে রিমোট-কন্ট্রোল সিস্টেমও বলে থাকেন। সূত্র মতে, ওই ট্রাফিকিং হয় স্বেচ্ছায় অর্থাৎ প্রলোভন দেখিয়ে একজনকে রাজী করানো হয়। সেও মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে এ পথে যায়। এদের প্রলোভন দেখিয়ে রাজী করানোর জন্য গ্রামেগঞ্জে কমিশনে দালালরা কাজ করে। ঠিক একইভাবে লিবিয়াতেও দালালরা থাকে খালাসি কাজে। অর্থাৎ মরুভূমি পার করা বা ভূমধ্যসাগরে নৌকায় তোলা- এটাই তাদের কাজ। মাঝে মধ্যে ধরপাকড়ে গ্রামের এবং লিবিয়ার প্রান্তিক দালালরা আটক বা শাস্তির শিকার হলেও বনানী, বারিধারা, দূবাই কিংবা ইস্তাম্বুলে আলিশান অফিস নিয়ে থাকা ভদ্রবেশী স্মাগলারা বারবরই থাকেন অধরা। সূত্রে প্রকাশ আদিকাল থেকে মানবপাচার হয়ে আসলেও গত কয়েক বছরে পাচারকারীরা নতুন এক পদ্ধতি চালু করেছে। এ পদ্ধতিতে ইউরোপ যেতে আগ্রহী বাংলাদেশীদের শুধু দেহটি থাকলেই যথেষ্ট বলে মনে করে পাচারকারীরা। কয়েকটি পথ ধরে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে বাংলাদেশীরা। এর প্রথমটি হলো ঢাকা টু লিবিয়া ভায়া দুবাই। দ্বিতীয়টি হলো ঢাকা থেকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপ প্রবেশের চেষ্টা, ব্যর্থ হলে লিবিয়া। তৃতীয়ত: ঢাকা টু দক্ষিণ সুদান, এরপর মরুভূমি হয়ে লিবিয়া। যে পথ দিয়েই বাংলাদেশিরা যান না কেন, ঢাকা থেকে বের করতে দালালরা তাদের প্রত্যেকের জন্য মাথাপিছু তাদের ৫০-৬০ হাজার আগাম ফি পরিশোধ করে। ফলে পাসপোর্টে বৈধ সিল নিয়েই তারা বাংলাদেশ ছাড়েন।
সেরা নিউজ/আকিব