সময়টা ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস। আদনান ইমতিয়াজ আর ইলমুল হক যখন জিপি এক্সিলারেটরের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন, তখন তাদের হাতে ছিল মাত্র একটা এক্সেল শিট। কিন্তু চোখে-মুখে ছিল সাহস আর জেতার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। শহরের মানুষের জন্য তারা একটি অনলাইন সেবা-কেন্দ্রের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন।
এমন একটি কেন্দ্র, যেখানে মানুষ সব ধরনের সেবা পাবে সহজে ও স্বাচ্ছন্দ্যে। সেদিন থেকে যাত্রা শুরু হলো সেবা এক্সওয়াইজেড বা Sheba.xyz নামের প্রতিষ্ঠানটির। বাকি গল্পটা হয়তো অনেকেই জানেন।
তিন বছরের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে সেবা ঘরে ঘরে জায়গা করে নিয়েছে। সেই ‘সেবা’ এখন শতকোটি টাকার এক বিশাল কোম্পানি, ১৫০ জন কর্মীর একটি প্রতিষ্ঠান এবং ২০ হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার একটি প্ল্যাটফর্ম। কৌতূহলী হয়ে আপনি বলতে পারেন, প্রতিষ্ঠানটি তাদের অ্যাপে এতগুলো সেবাকে একসঙ্গে করে কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং অনবরত সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
এত এত সেবার মান ধরে রেখে বাজারে নিজেদের এক নম্বর সেবাদানকারী প্রমাণ করার পেছনে রহস্যটা কী, কোনো জাদুকরি জারিজুরি নেই তো আবার? আদনান জানান, তাদের এমন একটি বিশেষ দল আছে, যারা একটি নতুন সেবা বাজারে আসার আগে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির (পাইলটিং) মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ‘এবি টেস্টিং’ করতে থাকে, আর তার সঙ্গে যোগ হতে থাকে তাদের পর্যবেক্ষণ ও মতামত। পরবর্তী সময়ে সেসব মতামত বিচার–বিশ্লেষণ শেষেই তৈরি হয় সবকিছু।
্যেভাবে তৈরি হল অসাধারণ একটি টিম : জিপি এক্সিলারেটর থেকে বের হয়ে আদনান ইমতিয়াজ যখন পুরোদমে তার টিম তৈরির পেছনে লাগলেন, সে সময়ের গল্পগুলোও বেশ মজার ও শিক্ষণীয়। আদনান জানান, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তিনি একজন যোগ্য ব্যক্তিকে আগে থেকেই নিশানা করে রেখেছিলেন। তবে একবার নয় দুবার নয়, রীতিমতো আটবারের চেষ্টার পর তিনি তাকে নিজেদের দলে ভেড়াতে পেরেছেন।
তাদের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা বা টেকনোলজি অফিসার নিয়োগের গল্পটাও মজার। আবু নাসের মো. শোয়াইব একদিন সেবার অফিসে আদনান ইমতিয়াজের কাছে হাজির হয়েছিলেন নিজের বানানো একটি ওয়েবসাইটের ‘ডেমো’ প্রদর্শন করতে।
কিন্তু তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে সেদিনই তাকে প্রস্তাব করে বসলেন দলের চিফ টেকনোলজি অফিসার পদ যোগ দেওয়ার জন্য। দলে আবু নাসের মো. শোয়াইবের সেদিনের সেই যোগদান বৃথা যায়নি। দিনে দিনে দল হয়ে উঠল আরও ভারী, আরও শক্তিশালী।
প্রাথমিক ভাবে ভাবনায় যা ছিল : আদনান ইমতিয়াজ শোনালেন নিজের কথা, এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার পেছনের কথা। তার ভাষায়, এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত হতাশা থেকে শুরু হয়েছিল। সারা সপ্তাহ প্রচণ্ড কাজের চাপ থাকে, আর এ থেকে মুক্তি পেতে তাই আমরা কমবেশি সবাই একটা আরামের শুক্রবার চাই। যদিও আমার ক্ষেত্রে শুক্রবার খুবই অন্য রকম দিন। কারণ, এদিন বাসার সমস্ত জমে থাকা কাজ, যেমন ভাঙা জানালাটা ঠিক করতে হবে, পাইপের লিক সারাতে হবে, ইত্যাদি। আর এ জন্য চাই কম খরচে একজন সঠিক লোক খুঁজে বের করা। আমার মনে হলো আমার বেশিরভাগ সহকর্মীই একই রকম পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেবা শিল্পে পেশাদারির মারাত্মক অভাব আছে, বিশেষত যখন প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় সেবা বা সার্ভিস পাওয়ার ক্ষেত্রে এমনটি হয়। অর্থাৎ আপনি আপনার প্রয়োজনে সঠিক সময়ে সঠিক লোকটিকে খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি এ রকম একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করার কথা মনে হলো। আর এ রকম এক ভাবনা মাথায় নিয়েই আমরা মূলত মানুষের প্রতিদিনের এই ঝামেলা দূর করতে চেয়েছিলাম।
গুণিতকের গুণিতক হারে সেবা : সেবা বাংলাদেশের তৃণমূল ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের একটি প্ল্যাটফর্মের আওতায় নিয়ে এসেছে। যেখানে তারা বাজারে সাধারণের তুলনায় আরও বেশিসংখ্যক ক্রেতার কাছে সেবা দিতে পারছে। যেমন ধরুন, একজন রাজমিস্ত্রি আগে হয়তো সারা দিনে দুটি বা একটি কাজের অর্ডার পেতেন, কিন্তু সেবার প্ল্যাটফর্মে চলে আসার পর কাজ পাওয়ার সুযোগ গুণিতক হারে বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮-১০টিতে। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে শতকোটি টাকার ভিন্ন ধরনের এই কোম্পানি।