সেরা নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক আইন পাশের পর প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও এখনো আইনটি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
দু’হাজার আঠারো সালের ২৯শে জুলাই ঢাকার দুই কলেজ শিক্ষার্থী সড়কে বাস চাপায় প্রাণ হারানোর পর শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৯শে সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন পাস করে সরকার।
একই বছর সেপ্টেম্বরে আইনটি পাশ হলেও সেটি কার্যকর করা হয় পরের বছর পহেলা নভেম্বর থেকে।
কিন্তু তখন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও কর্মবিরতির মুখে সরকার চারটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত বন্ধ রাখে।
সেই বন্ধ থাকার মেয়াদ এই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ফলে আইনটি আংশিকভাবে কার্যকর হলেও প্রধান কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ আটকে রয়েছে।
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালক খন্দকার অলিউর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”জুন মাস পর্যন্ত এইসব ক্ষেত্রে আইনটি প্রয়োগ শিথিল থাকলেও সম্প্রতি তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে এই সংক্রান্ত একটি সার্কুলার আমরা পেয়েছি।”
জানা গেছে, নভেম্বর মাস থেকেই আইনটির ৭৪, ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারায় মামলা করছে না পুলিশ।
ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনারের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম-কমিশনার আবদুর রাজ্জাক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”আমরা জুলাই মাস থেকে থেকেই পুরোদমে আইনটির প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছি। তবে চারটি ধারায় ডিসেম্বর পর্যন্ত মালিক-শ্রমিকদের সুযোগ দেয়ায় সেগুলোয় আপাতত কোন মামলা হচ্ছে না।”
তিনি জানান, মালিক-শ্রমিকদের অনেকে বলেছেন, কোভিড-১৯ এর কারণে তারা ফিটনেস বা লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেননি। তাই তাদের আরও কিছুদিন সময় দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলছেন, “একটা আইন পাশ করে সেটার কিছু ধারা আবার স্থগিত করে রাখা তো একপ্রকার প্রতারণার শামিল।
“আর সংসদে পাশ হওয়া একটি আইন রহিত করতে হলেও সংসদে করতে হয়। কোন মন্ত্রী তো মুখের কথায় তা করতে পারেন না। এখানে আসলে জনগণের সঙ্গে একটা তামাশা করা হচ্ছে।”
তিনি বলছেন, ”সরকার আসলে পরিবহন মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ভয় পায়। আইনটি যখন কার্যকর করা হলো, তখন অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের নামে সারাদেশে যেভাবে পরিবহন বন্ধ করে দেয়া হলো, সেই কারণে সরকার তাদের ভয় পায়।
“ভয় পায় বলেই সরকার আইনটিকে একটা ধোঁয়াশার জায়গায় রেখেছে। জনগণ জানে না, দেশে কি আদৌ এই আইনটা আছে নাকি পুরনো আইনে চলছে?”
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, ”বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন আইন পাশের পর সেটার প্রয়োগ এভাবে বার বার পিছিয়ে দেয়া একটি নজিরবিহীন ঘটনা। নিরাপদ সড়কের চাপ কমিয়ে দিতেই মালিক-শ্রমিকদের চাপে এটা করা হচ্ছে।”
যেসব ধারা নিয়ে জটিলতা
গত বছরের নভেম্বর মাসে মালিক-শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও আপত্তির মুখে আইনটির কয়েকটি ধারার প্রয়োগ জুন মাস পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার, যা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
তাদের মূল আপত্তি ছিল ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ নম্বর ধারা, যেসব অপরাধ জামিনযোগ্য। ৮৪ নম্বর ধারায় মোটরযানের কারিগরি পরিবর্তন, ৯৮ ও ১০৫ নম্বর ধারায় সড়ক দুর্ঘটনায় শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া ৭৪ নম্বর ধারায় ফিটনেস সনদ থাকার বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে।
এরকম মোট নয়টি ধারার বিরুদ্ধে মালিক-শ্রমিকদের আপত্তি। তাদের কর্মবিরতি এবং দাবির মুখে গত বছরের ২০শে নভেম্বর মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের আপত্তির নয়টি ধারায় জুন মাস পর্যন্ত আইনের প্রয়োগ শিথিল রাখার সিদ্ধান্ত জানান।
এছাড়া আইনের পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনার জন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০ লাখের মতো চালকের লাইসেন্স আছে এবং ৬০ শতাংশের বেশি বাস, ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যানের ফিটনেস নাই।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী ইলিয়াস কাঞ্চন সেই সময় বলেছিলেন, চাপের মুখে আইনটি কার্যকর করা না গেলে সেটা সবার জন্যই পরাজয় হবে। এই বক্তব্য তিনি ঐ বৈঠকেও তুলে ধরেছেন বলে জানিয়েছেন।
“এবার যদি আমরা এই আইন বাস্তবায়ন করতে না পারি, এবার যদি আমরা হেরে যাই, তাহলে হেরে যাবে পুরো বাংলাদেশ।”
নিরাপদ সড়ক নিয়ে কয়েক দশক ধরে আন্দোলন করে আসছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।
শ্রমিকদের এসব দাবি দাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, আইনের কোন বিষয় নিয়ে ছাড় দেয়া ঠিক হবেনা।
“এবার যদি আমরা হেরে যাই, তাহলে হেরে যাবে পুরো বাংলাদেশ’
সেরা নিউজ/আকিব