মাঝেমাঝেই ‘কানাডায় স্কুলিং ভিসা’ নামের আড়ালে অনেক প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দেখা যায়। অনেকে এ ধরনের বিজ্ঞাপন আমার নজরেও আনেন। কেউ কেউ আবার আবদার করে আমার কাছে দাবিও তোলেন, ‘স্যার, কানাডার রেজিস্টার্ড ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি) হিসেবে প্রতারণামূলক ইমিগ্রেশন বিজ্ঞাপন বিষয়ে দেশের মানুষকে সচেতন করতে আপনার কিছু বলা উচিত।’ মূলত সে প্রসঙ্গেই আজ দু-চারটে কথা বলতে চাইছি।
আমার ফেইসবুকের ইনবক্সে পাওয়া একটি রংচঙা বিজ্ঞাপনের ভাষা দেখলাম এরকম: ‘স্কুলিং ভিসায় কানাডা গমনের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। যোগাযোগ: …।’ যিনি বিজ্ঞাপনটি আমাকে পাঠিয়েছেন তিনি একটি প্রশ্নও ছুঁড়ে দিয়েছেন সাথে, ‘দয়া করে জানাবেন, এই বিজ্ঞাপনের কথাগুলো কি সঠিক?’ আমি তাকে কোনও উত্তর দেইনি; কারণ, এ প্রশ্নের উত্তর অনেক দীর্ঘ।
এবার ওই বিজ্ঞাপনের ভাষাটা একটু বিশ্লেষণ করি। প্রথমত,, কানাডা ইমিগ্রেশনে ‘স্কুলিং ভিসা’ নামের আলাদা কোনও ভিসা নেই। ‘স্কুলিং ভিসা’ শব্দগুলো সম্ভবত বাঙালির উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কার। এটা আসলে ‘স্টাডি পারমিট ফর মাইনর চিলড্রেন’ নামেই কানাডায় পরিচিত। আমার ধারণা, বিশেষ উদ্দেশ্য মাথায় রেখে কেউ কেউ বাংলাদেশে এটাকে ‘স্কুলিং ভিসা’ নাম দিয়েছে। বিজ্ঞাপনটির ভাষা দেখে মনে হতে পারে, কানাডা গমনের জন্য এটি একটি বিশেষ ধরনের ভিসা যাতে বাবা-মা চাইলে সহজে কানাডয় যেতে পারেন। আসলে ব্যাপারটি তেমন কিছু নয়।
বিশেষ কিছু শর্ত পূরণে সক্ষম হলে আপনি অবশ্যই আপনার শিশু সন্তান কানাডায় পড়াতে পাঠাতে পারেন। এতে কোনও সমস্যা নেই; অনেকে পাঠাচ্ছেনও। সমস্যার সৃষ্টি তখনই, যখন কেউ মনে করেন বাচ্চা পড়ছে অজুহাতে তিনিও বাচ্চার পিছু পিছু কানাডা গমন করে ধীরে ধীরে কানাডার স্থায়ী অভিবাসী হয়ে যেতে পারবেন।
তাহলে বিজ্ঞাপনদাতারা বাবা-মাকেও কানাডা গমনের লোভ দেখাচ্ছেন কোন যুক্তিতে? এক অর্থে তারা কিন্তু মিথ্যে বলছেন না। কারণ, বাবা-মা বা তাদের যেকোনও একজন টেম্পরারি বা অস্থায়ী ভিসা (ভিজিট ভিসা) নিয়ে কানাডা যেতে পারেন। ‘ভিজিট ভিসা’ আবেদনের কারণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে বাচ্চার সাথে থেকে তার দেখভাল করা। তবে, এ কাজে বাবা-মা দুইজন প্রয়োজন নেই বলে ভিসা অফিসার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুজনের একজনকে ভিজিট ভিসা দিয়ে থাকতে পারেন; ভিসা দিতেই হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা ভিসা অফিসারের নেই যদিও। দুৰ্ভাগ্যবশত, দুজনের কেউই ভিসা না পেলে কানাডায় আপনার বাচ্চার থাকা-খাওয়া ও দেখভালের বিষয়ে বিকল্প ব্যবস্থার উদ্যোগ কিন্তু আপনাকেই নিতে হবে।
ধরলাম, বাচ্চার সাথে কানাডা যাওয়ার জন্য পিতামাতার একজন ভিজিট ভিসা পেলেন। তারমানে কিন্তু এ নয় যে আপনি কানাডা গিয়ে সুযোগমতো চাকরি করে ফাঁকতালে কিছু আয় উপার্জনও করে ফেলবেন! করলে সেটা হবে অবৈধ। ভিজিট ভিসা নিয়ে আপনি কোনভাবেই কানাডায় চাকরিবাকরি বা পড়াশোনা করতে পারেন না। পড়াশোনা করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই আলাদাভাবে স্টাডি পারমিটের আবেদন করতে হবে। বা, কাজ করতে গেলে আবেদন করতে হবে ওয়ার্ক পারমিটের। ভিজিটর ভিসা নিয়ে কানাডায় এসব ব্যবস্থা করা, বিশেষ করে ওয়ার্ক পারমিট পাওয়া, বেশ কঠিনই বটে। তাই, সত্যিকার অর্থেই যদি আপনার নাবালক সন্তানকে কানাডায় পড়াশোনা করাতে চান তাহলে আপনাকে সন্তানের এবং (ভিসা পেলে) আপনার নিজের খরচপাতি চালানোর ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেই সে কাজে হাত দেওয়া উচিত।
এ পর্যায়ে আপনার মাথায় হয়তো প্রশ্ন জাগছে, এ কাজে খরচ কেমন লাগতে পারে? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়; তবে কমবেশি মাসিক কানাডিয়ান দুই হাজার পাঁচশ ডলার, যা বাংলা টাকায় কমবেশি এক লাখ ষাট হাজার টাকা, খরচ হতে পারে বলে আমার ধারণা, যা বছরে আনুমানিক বিশ লাখ টাকা ধরা যায়। এতে বাচ্চার টিউশন ফি-সহ আনুষঙ্গিক খরচাদি এবং বাবা-মায়ের একজনের থাকা-খাওয়ার খরচ বিবেচনায় রেখেছি। দেশে আসা যাওয়ার খরচ কিন্তু আলাদা। আবারো বলছি, বাচ্চা কানাডা আসছে বলেই আপনাকে ‘ভিজিট ভিসা’ দিতে হবে বলে ভিসা অফিসারের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। ভিসা না পেলে কানাডায় বাচ্চার দেখাশোনার বিকল্প ব্যবস্থা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে।
এবার বুঝুন উপরের বিজ্ঞাপনের ভাষা কতোখানি সত্য বা মিথ্যা। তবে আমি বলবো, যেহেতু বিজ্ঞাপনের ভাষা হতে মানুষ সার্বিক বিষয়ে একটা ভুল ধারণা পাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তাই, এ ভাষা না সত্য, না পুরোপুরি মিথ্যা; বলা চলে, সত্যের অপলাপ। অর্থাৎ, মহাভারত’-এর অন্যতম প্রধান চরিত্র যুধিষ্ঠিরের সেই ‘সত্য’ ভাষণের মতোই অর্ধ সত্য: ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ।’ দ্রোণ ভাবতেন, যুধিষ্ঠির কখনো মিথ্যে বলেন না, তাই, তার কথা বিশ্বাস করে শেষতক নিজের প্রাণ খুইয়েছিলেন দ্রোণ।
যাক, যারা বাচ্চাদের পড়ানোর উদ্দেশ্যে কানাডা পাঠানোর কথা সক্রিয় বিবেচনায় রেখেছেন তাদের জন্য কিছু কথা বলে আজকের পর্ব শেষ করবো। আপনাদের কেউ একজন বাচ্চার সাথে ভিজিট ভিসা নিয়ে কানাডা আসার সুযোগ পেলে কানাডার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ইমিগ্রেশন পরামর্শকদের সাথে যোগাযোগ করে জেনে নিতে পারেন কিভাবে কানাডায় আপনি নিজেও ধীরে ধীরে স্থায়ী বসবাসের পরিবেশ বা সুযোগ তৈরি করতে পারেন।
এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, কানাডায় কিভাবে কোন স্টাডি প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া যায় তা নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে। যদি দেখা যায়, আপনার উপযোগী কোনও স্টাডি প্রোগ্রাম পেয়ে গেছেন যা ভবিষ্যতে আপনাকে কানাডায় ইমিগ্রেশন পেতে সহায়তা করবে, তাহলে আপনি সে স্টাডি প্রোগ্রামে ভর্তির উদ্যোগ নিতে পারেন। এটা অসম্ভব বা দোষের কিছু নয়।
এক্ষেত্রে আপনাকে একটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। তা হলো, আপনি যে বিষয়ে পড়াশোনা করতে চাইছেন, বা যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে চাইছেন তা পরবর্তীতে আপনাকে কানাডা ইমিগ্রেশনের বিষয়ে কতটা হেল্প করবে। যেকোনও প্রতিষ্ঠানের যেকোনও স্টাডি প্রোগ্রাম শেষ করে কিন্তু কানাডা ইমিগ্রেশনের আবেদন করা যায় না। আপনি স্টাডি পারমিট নিয়ে কানাডায় পড়াশোনা শুরু করতে পারলে আপনার সন্তান কিন্তু টিউশন ফি ছাড়াই কানাডায় পড়াশোনা করতে পারবে। তারমানে, আপনার খরচ নেমে আসবে প্রায় অর্ধেকে।
নিয়ম কানুন মেনে ধীরেসুস্থে আগালে সন্তানের পড়াশোনার পাশাপাশি কানাডায় সেটেল হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু, বাঁকা পথে কিছু করতে গেলে, যেমন, রাতের আঁধারে চোরাগোপ্তা কিছু কাজ করে ক্যাশ ডলার কামানোর মতো বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়লে আপনার এবং একই সাথে, আপনার সন্তানের কানাডা-ভবিষ্যত গভীর অন্ধকারে নিপতিত হতে পারে। তেমন ভুল যেন না করেন।
যাক, এ লেখা আর দীর্ঘায়িত না করি। কানাডায় পড়াশোনা, বা ইমিগ্রেশন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইল ঠিকানায় জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে।
এছাড়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে আমার লেখা পড়তে। আপনাদের সাথে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের আগ্রহ নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি।
লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি।
ইমেইল: [email protected]
সেরা নিউজ/আকিব