বিশেষ প্রতিবেদক:
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। ঝুলে থাকা রাজ্য পেনসিলভানিয়ায় জয় পেয়ে হোয়াইট হাউসের দুয়ার খুলে যায় তার। এ রাজ্যের ২০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট যোগ হলে তার ইলেকটোরাল ভোট দাঁড়ায় ২৮৪টিতে। জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ২৭০টি। পরে নেভাদাতেও জয় পেলে তার ইলেকটোরাল ভোট দাঁড়ায় ২৯০টিতে। তখনও (বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ১১টা, ওয়াশিংটন সময় সকাল ১০টা) তিন রাজ্যে ভোট গণনা চলছিল। তখন পর্যন্ত ট্রাম্পের ইলেকটোরাল ভোট ছিল ২১৪টি।
বাইডেনের জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস। এর মধ্য দিয়ে দেশটির ইতিহাসে প্রথম কোনো নারী ও প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ এ আসনে বসলেন।
ফল ঘোষণা নিয়ে চার দিন ধরে রুদ্ধশ্বাস সময় কাটছিল মার্কিনিদের। বিশ্বও তাকিয়ে ছিল এ ফলের দিকে। ট্রাম্প ও তার দল রিপাবলিকানদের নানা কার্যকলাপে বাড়ছিল উত্তেজনাও। বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টায় পেনসিলভানিয়ার ফল ঘোষণা করা হলে সঙ্গে সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন বাইডেন সমর্থকরা। তারা রাস্তায় নেমে এসে নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। অভিনন্দন জানান নতুন রাষ্ট্রপ্রধানকে। বিশ্বনেতারাও অভিনন্দন জানিয়েছেন বাইডেনকে।
এর আগে ‘ডিসিশন ডেস্ক’ নামে তথ্য ও ডাটা বিশ্লেষণকারী একটি প্রতিষ্ঠান জানায় জো বাইডেনই যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন। এতে বাইডেন সমর্থকরা খুশিতে নাচলেও ট্রাম্প সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হন। বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট মেনে নিতে রাজি নন তারা। তাদের মতে, বাইডেন চীনের এজেন্ট। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে দেশ রসাতলে যাবে। এসব বলে তারা বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ করে চলেছেন। ট্রাম্পও ভোট গণনা প্রশ্নবিদ্ধ করে একের পর এক স্ট্যাটাস দেন। এমন পরিস্থিতিতে রাজ্যে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।
ভোট গণনা যতটা এগিয়ে যাচ্ছিল ততই জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলেন জো বাইডেন। ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর কী করবেন পেনসিলভানিয়ার ফল ঘোষণার আগেই সে কথা জানিয়ে দেন তিনি। শুক্রবার রাতে জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তার প্রথম কাজ হবে করোনা সংক্রমণ রোধে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা। আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। দলীয় সমস্যা নিয়ে যুদ্ধ করার সময় আমাদের নেই। আমরা প্রতিপক্ষ হতে পারি, কিন্তু আমরা একে অপরের শত্রু নই।’
তিনি বলেন, ‘আমরাই জিততে চলেছি। সবাই শান্ত থাকুন। ধৈর্য ধরুন। যারা ভোট দিয়েছেন বা দেননি আমি সবার প্রেসিডেন্ট হব। ২৪ ঘণ্টা আগেও আমি পিছিয়ে ছিলাম। এখন এগিয়ে।’
নির্বাচনের সবশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে বাইডেন আরও বলেন, আমরা ৩০০ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেতে যাচ্ছি। যদিও নির্বাচনে বিজয়ের চূড়ান্ত ঘোষণা এখনও আসেনি। তবে সংখ্যা বলছে এটি পরিষ্কার যে, আমরাই জিততে যাচ্ছি। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বলেন, আমরা সাত কোটি ৪০ লাখের বেশি ভোট পেয়েছি; যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আর কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পাননি।
বাইডেন বলেন, ‘গতকাল থেকে কী ঘটেছে শুধু তার দিকে তাকান। ২৪ ঘণ্টা আগেও জর্জিয়ায় আমরা পিছিয়ে ছিলাম, এখন আমরা এগিয়ে রয়েছি। এখন এই রাজ্যে আমরা জয়ী হতে চলেছি। আমরা পেনসিলভানিয়ায়ও পিছিয়ে ছিলাম আর এখন সেখানে অনেক এগিয়ে। আমরা অ্যারিজোনায় জয়ী হচ্ছি, নেভাদায় জয়ী হচ্ছি, সেখানে অনেক বেশি ভোটে এগিয়ে গেছি।’
এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর আস্থা রেখে ধৈর্য ধরতে ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বিভেদ ভুলে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
অপর দিকে হোয়াইট হাউসে অনেকটাই একা হয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফল ঘোষণার আগেই পদত্যাগ করেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এস্পার। গুঞ্জন উঠেছে, হোয়াইট হাউসের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারাও তাকে এড়িয়ে চলছেন। সারা দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অভিযোগ করেই যাচ্ছেন ট্রাম্প। বলছেন, ভোট কারচুপি হয়েছে। যদিও এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ এখনও দেখাতে পারেননি তিনি।
ভোট গণনা চলছিল ধীরগতিতে। বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভোট গণনায় নর্থ ক্যারোলিনা ও আলাস্কায় এগিয়ে ছিলেন ডোনাল্ট ট্রাম্প। আর বাইডেনের এগিয়ে থাকা অবস্থায় জর্জিয়ায় পুনঃ ভোট গণনা চলছিল।
ট্রাম্পের সঙ্গ ছাড়তে শুরু করেছেন হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা : ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট হতেই তার সঙ্গ ছাড়তে শুরু করেছেন হোয়াইট হাউসের অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। এমনকি ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার শিবিরের কয়েকজন কর্মকর্তাও কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে ট্রাম্পের আর আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নেই বলে জানিয়েছেন তার একজন উপদেষ্টা। সিএনএনকে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি ছিল এক ধরনের মিথ্যাচার। ওই ঘটনার পর হোয়াইট হাউসের অনেক কর্মকর্তা তাদের বিভাগীয় প্রধানদের কাছে ট্রাম্পের পরবর্তী করণীয় নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানান। বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের পরবর্তী করণীয় কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই উপদেষ্টা বলেন, ‘সেটা ঈশ্বর ভালো জানেন।’
বিভিন্ন সূত্র জানায়, রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ও নিজের ঘনিষ্ঠজনেরা ট্রাম্পকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। ভোট গণনায় জালিয়াতির অভিযোগ ট্রাম্পের দলেই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। এ নিয়ে দলে চরম মতভেদ দেখা দিয়েছে।
পেনসিলভানিয়ায় দেরিতে আসা ব্যালট আলাদা রাখার নির্দেশ সুপ্রিমকোর্টের : বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনের দিন রাত ৮টার পর কেন্দ্রে আসা ব্যালট আলাদাভাবে গণনা করতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের বিচারক স্যামুয়েল অ্যাল্টো। এর আগে পেনসিলভানিয়ায় দেরিতে আসা ভোট গণনা না করার জন্য রিপাবলিকানরা আইনি চ্যালেঞ্জ করলেও তা অনুমোদিত হয়নি। তার বদলে ৩ নভেম্বরের পরে আসা ব্যালটগুলো আলাদা করে গণনা করার নির্দেশ দেন আদালত।
পেনসিলভানিয়ায় শুরুতে ট্রাম্প এগিয়ে থাকলেও পোস্টাল ব্যালটের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে বাইডেন এগিয়ে যেতে শুরু করেন। বর্তমানে ২৭ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন বাইডেন। এখানকার ২০টি ইলেকটোরাল ভোটে জয় নিশ্চিত হলে বাইডেন জয়ের জন্য প্রয়োজন ২৭০টিরও বেশি ইলেকটোরাল ভোট পাবেন।
ভোট গণনা প্রশ্নবিদ্ধ করে ফের ট্রাম্পের টুইট : ভোট গণনা প্রশ্নবিদ্ধ করে সামাজিকমাধ্যমে ফের টুইট করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে তিনি বলেন, নির্বাচনী রাতে এসব রাজ্যে আমি বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, সেই ব্যবধান অলৌকিকভাবে নাই হয়ে যাচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়া সামনে, এগুলো সম্ভবত সেই ব্যবধান আবার ফিরে আসবে।
উল্লেখ্য, ৪৫ রাজ্যে গণনা শেষে ইলেকটোরাল ভোটে যখন বাইডেন এগিয়ে যান, ঠিক সেই মুহূর্তে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করেন ট্রাম্প। এরপর বাকি পাঁচ রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট নিয়ে চলছিল না জল্পনা-কল্পনা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা ও অ্যারিজোনায় ভোট গণনায় এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। আর নেভাদায় এগিয়ে ছিলেন বাইডেন। তবে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দু’জনের ভোটের ব্যবধান কমতে থাকে। ইতোমধ্যে জো বাইডেন জর্জিয়া, অ্যারিজোনা ও পেনসিলভানিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ট্রাম্পকে ছাড়িয়ে ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে গেছেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভোট গণনার চতুর্থ দিন পর্যন্ত পাওয়া ফলাফলে জো বাইডেন ২৬৪টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছেন। আর রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২১৪ ভোট।
ভোট জালিয়াতির কোনো প্রমাণ নেই- ফেডারেল নির্বাচন কমিশন : ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা এলেন উইনট্রব বলেছেন, নির্বাচনে কোনো ধরনের ভোট জালিয়াতির প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। শনিবার সকালে তিনি সিএনএনকে এ কথা বলেন।
এলেন বলেন, ‘দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কর্মকর্তা এবং নির্বাচনী কর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করছেন। নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, তাতে খুবই নগণ্য অভিযোগ এসেছে। বাস্তবসম্মত ও অকাট্য প্রমাণ আছে এমন অভিযোগ খুবই কম। ভোট জালিয়াতির কোনো প্রমাণ নেই। অবৈধ ভোট নেয়া হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই। মুখে কিছু বলে দিলেই তো হল না।’
সেরা নিউজ/আকিব