সেরা নিউজ ডেস্ক:
প্রায় ৫০ বছরের পথযাত্রা। দীর্ঘদিনের ধৈর্য্য আর কৌশল তার সম্বল। সঙ্গে মানুষের মন জয় করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা। স্ত্রী, সন্তান বিয়োগেও তিনি বিচ্যুত হননি। তার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া। অবশেষে, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তার কাছে ধরা দিয়েছে হোয়াইট হাউস। তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। একজন গাড়ি বিক্রেতার ছেলে থেকে তিনি হয়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
তিনি জো বাইডেন। তিনি এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে এই নির্বাচনী লড়াই করে জিতেছেন, যখন সবকিছু এলোমেলো। শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ এক করোনাভাইরাস মহামারি চলছে। অপ্রত্যাশিত সামাজিক এক অস্থিরতা চলছে। আর প্রথাবিরোধী একজন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তাকে লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু সব প্রতিকূলতাকে তিনি অতিক্রম করেছেন। বিবিসি’র বিশ্লেষণে ৫টি কারণে তিনি এবার নির্বাচিত হয়েছেন। সেগুলো হলো-
কোভিড-১৯: বাইডেন এমন একটি কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন যা ছিল সমপূর্ণ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রে এ মহামারিতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার। পাশাপাশি এ মহামারির কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে মার্কিনিদের স্বাভাবিক জীবন। যার বড় প্রভাব পড়েছে ২০২০ সালের রাজনীতিতে। ট্রামপ নিজেও বিষয়টি নিয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি তার শেষ দিকের প্রচারণায় কোভিড-১৯ নিয়ে এতো সংবাদ নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করেন। উইসকনসিনে তিনি বলেন, চারদিকে শুধু ‘ফেক নিউজ’, শুধু কোভিড, কোভিড, কোভিড।
মহামারি সম্পর্কে তার যে অবস্থান, যেভাবে তিনি বিষয়টি সামলেছেন সেটি শেষ পর্যন্ত তার বিপক্ষেই গেছে। অপরদিকে জো বাইডেন শিবির কোভিড ইস্যুতে যে অবস্থান নিয়েছিলেন সেটি তাকে এগিয়ে দিচ্ছে এমনটাই দেখা যায় গত মাসে করা এক জনমত জরিপে। এতে জো বাইডেন ১৭ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি ছিল ডনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারিতে যে ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা কৌশলকে বাধাগ্রস্ত করেছে। মহামারি ও এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডনাল্ড ট্রাম্প প্রায়শই যেভাবে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছেন, বিজ্ঞানকে প্রশ্ন করেছেন, একদম হুট করে এলোমেলোভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পক্ষপাতমূলক আচরণ এই বিষয়গুলো জো বাইডেন ক্যাম্প সফলভাবে ডনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে কাজে লাগিয়েছে।
হিসাব কষে ধীরগতির প্রচারণা: জো বাইডেন তার দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে ভুল বক্তব্য ও অসমীচীন কাজের জন্য বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন। যেসব ভুল তাকে প্রায়শই বিপদগ্রস্ত করেছে। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে এমন ভুল তার হারের কারণ ছিল। ২০০৭ সালে আবার যখন তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন সেবার তার তেমন একটা সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু তৃতীয়বার যখন ওভাল অফিসের জন্য লড়েছেন তখন তিনি বক্তব্য দেয়ার সময় যথেষ্ট কম হোঁচট খেয়েছেন। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে ডনাল্ড ট্রাম্প নিজে তার লাগামহীন অসামঞ্জস্যপূর্ণ নানা বক্তব্যের কারণে নিয়মিত খবরের উৎস ছিলেন। বৈশ্বিক মহামারি, অর্থনৈতিক সংকট, জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পর বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময়ের সহিংস বিক্ষোভ এরকম জাতীয় পর্যায়ের বড় ঘটনার দিকে সমাজের মানুষের মনোযোগ বেশি ছিল। এর বাইরে এবার বাইডেন ক্যাম্প খুব হিসাব কষে এগিয়েছে। বাইডেনকে যতটা সম্ভব কম জনসম্মুখে আসতে দেখা গেছে। প্রচারণার গতি এমন ছিল যাতে প্রার্থী ক্লান্তি থেকে অসাবধানতাবশত কিছু না করে বসেন। বাইডেন ক্যাম্প বরং ট্রাম্পকে তার মুখ খোলার সুযোগ দিয়েছে যা শেষ পর্যন্ত কাজে লেগেছে।
আর যেই হোক ট্রাম্প নয়: নির্বাচনের দিনটির এক সপ্তাহ আগে জো বাইডেন ক্যাম্প তাদের সর্বশেষ টেলিভিশন বিজ্ঞাপন প্রচার করে। গত বছর জো বাইডেন প্রার্থী হিসেবে যখন মনোনীত হন এবং যেদিন তার প্রচারণা শুরু করেন সে সময়কার বক্তব্যের সঙ্গে এই বিজ্ঞাপনের বক্তব্যে বেশ লক্ষণীয় সাদৃশ্য ছিল। এই নির্বাচনকে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের আত্মরক্ষার যুদ্ধ হিসেবে। ডনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরকে বিভক্তি ও বিশৃঙ্খলার সময়কাল বলে উল্লেখ করা হয়। ট্রাম্পের সময় যে মেরূকরণ হয়েছে, যে ধরনের বিতর্কের জন্ম তিনি দিয়েছেন মার্কিন জনগণ তা থেকে মুক্তি চেয়েছে। তারা শান্ত ও অবিচল একজন নেতা চেয়েছেন। ভোটারদের অনেকেই বলেছেন তারা ব্যক্তি হিসেবে ট্রাম্পের আচরণে রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ। বাইডেন ক্যাম্প ডনাল্ড ট্রাম্পকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে এই নির্বাচন যেন দুই প্রার্থীর মধ্যে যোগ্য একজনকে বেছে নেবার নির্বাচন নয়। এটি যেন ট্রাম্প সম্পর্কে একটি গণভোটের মতো বিষয়, এমন কৌশল ছিল বাইডেনের প্রচারণায়। জো বাইডেন ডনাল্ড ট্রাম্প নন, এমন বার্তা দেয়া হয়েছে ভোটারদের।
মধ্যপন্থি অবস্থান: প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হবার লড়াইয়ে জো বাইডেনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বামপন্থি বার্নি স্যান্ডার্স। আর একজন ছিলেন এলিজাবেথ ওয়ারেন। যার ক্যাম্পেইনে বেশ ভালো অর্থের যোগান ছিল। এই দুজনের যেকোনো সভায় রক গানের কনসার্টের মতো মানুষ জড়ো হতো। কিন্তু জো বাইডেন উদারপন্থিদের চাপের মুখেও মধ্যপন্থি অবস্থান বজায় রেখেছেন। বামপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বী থাকায় বাইডেন সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, বিনামূল্যে কলেজ শিক্ষা ও ধনীদের জন্য বেশি কর আরোপ করার নীতিগুলোতে সমর্থন দেননি। এর ফলে তিনি মধ্যপন্থি ও অসন্তুষ্ট রিপাবলিকানদের কাছে টানতে পেরেছেন। কমালা হ্যারিসকে রানিংমেট হিসেবে বেছে নেবার সিদ্ধান্তে এটি প্রকাশ পেয়েছে। বার্নি স্যান্ডার্স ও এলিজাবেথ ওয়ারেনের সঙ্গে শুধু একটি জায়গায় মতের মিল ছিল বাইডেনের। আর তা হলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা। এই ইস্যু দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে আকর্ষণ করেছেন তিনি যাদের কাছে জলবায়ু পরিবর্তন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বেশি অর্থ, কম সমস্যা: এই বছরের শুরুতে জো বাইডেনের প্রচারণা তহবিল প্রায় শূন্য ছিল বলা যায়। ট্রাম্পের বিপক্ষে তার সীমাবদ্ধতা ছিল এটি। ট্রাম্পের প্রচারণা ছিল শত কোটি ডলারের বিষয়। কিন্তু এপ্রিল মাসে এসে তহবিল গঠনে জোরালোভাবে লেগে পড়ে বাইডেন শিবির। অন্যদিকে ট্রাম্পের পদ্ধতি হচ্ছে বাড়াবাড়ি অপচয়। নির্বাচনী প্রচারণার শেষের দিকে এসে ট্রাম্প ক্যাম্পের চেয়ে বড় তহবিল গড়েছিলেন বাইডেন। অক্টোবর মাসে ট্রাম্পের চেয়ে ১৪৪ মিলিয়ন ডলার বেশি ছিল বাইডেনের তহবিলে। যা ব্যবহার করে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে রিপাবলিকানদের জর্জরিত করে ফেলা হয়। কিন্তু শুধু অর্থ দিয়েই সব হয় না। ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনও বড় তহবিল গড়েছিলেন। কিন্তু এবার করোনাভাইরাস মহামারির কারণে একদম মানুষের কাছে গিয়ে প্রচারণা অনেক কমিয়ে দিতে হয়েছে। মানুষজন অনেক বেশি সময় ঘরে কাটিয়েছে তাই গণমাধ্যমের প্রতি তাদের মনোযোগ অনেক বেশি ছিল। ভোটার আকর্ষণ করতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গণমাধ্যমে বার্তা দিয়ে গেছেন জো বাইডেন।
সেরা নিউজ/আকিব