স্টাফ রিপোর্টার:
দেশের নাগরিকদের করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার জন্য প্রায় এক লাখ কর্মী প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর মধ্যে সরাসরি টিকা দেওয়ার কাজে মাঠে থাকবেন ৭২ হাজার কর্মী। পরিকল্পনা, সমন্বয়, পর্যবেক্ষণ এবং তদারকি, মূল্যায়ন, পরামর্শ দেওয়ার কাজে থাকবেন আরও কয়েক হাজার জনবল। টিকা দেওয়ার জন্য জাতীয় পরিকল্পনায় এমন তথ্য রয়েছে। টিকা কেনা ও কারিগরি ব্যয়ের বাইরে সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার বা এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী চিহ্নিত হয়। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। বর্তমানে আক্রান্তের হিসাবে বিশ্বের শীর্ষ-২০ এবং মৃত্যুর হিসাবে শীর্ষ-৩০ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ভাইরাসের কারণে আর্থ-সামাজিক খাতেও বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বেড়েছে। কমে গেছে অর্থনীতির গতি। এ পরিস্থিতিতে ভাইরাসের বিস্তার রোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি নাগরিকদের টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। টিকা পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। সেরাম ইনস্টিটিউট যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি টিকা সরবরাহ করবে। দেশের মানুষের কাজের ধরন, বয়স, ঝুঁকি বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হবে। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার একটি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। যাকে বলা হচ্ছে ‘ন্যাশনাল ডেপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ভ্যাকসিনেশন প্ল্যান ফর কভিড-১৯ ভ্যাকসিন ইন বাংলাদেশ’। এ পরিকল্পনায় টিকা আমদানির পর দেশে সংরক্ষণ, সব পর্যায়ে টিকা কেন্দ্র স্থাপন এবং টিকা প্রদানকারী, স্বেচ্ছাসেবক, নিরাপত্তা প্রহরী ও সুপারভাইজার নিয়োগ, পরিবহন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী টিকাদান কর্মসূচির মাঠ পর্যায়ে সরাসরি কাজ করবেন ৭১ হাজার ৩০৯ জন। এদের মধ্যে টিকা দানকারী থাকবেন ২০ হাজার ৮০০ জন। স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন ৪১ হাজার ৬০০ জন। উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা পর্যায়ে সুপারভাইজার থাকবেন ৮ হাজার ৮৬৯ জন। ৫ হাজার ৪৬৯ জন দারোয়ান থাকবেন। বিভাগীয় পর্যায়ে ২৪ জন ও জাতীয় পর্যায়ে ১৬ জন সুপারভাইজার থাকবেন। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা, সমন্বয়, পর্যবেক্ষণ, তদারকি, মূল্যায়নে পরামর্শকরা থাকবেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনাভাইরাসের টিকা সুষ্ঠুভাবে দেওয়ার জন্য একটি দিকনির্দেশনামূলক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সব ধরনের নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। নাগরিকরা যাতে সম্পূর্ণ ঝামেলাবিহীনভাবে টিকা নিতে পারেন, তা নিশ্চিত করা হবে। ইতোমধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী তালিকা করা, টিকা দানকারী নির্বাচনসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
করোনার টিকা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের টিকাদান কর্মসূচির কাঠামো ও জনবল ব্যবহার করা হবে। এর সঙ্গে করোনার টিকার জন্য গঠিত জাতীয় কমিটিসহ অন্যান্য কমিটি যুক্ত হবে। কাদের কখন টিকা দেওয়া হবে তার তালিকা হবে জেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে গঠিত কমিটির আওতায়। বিভিন্ন এলাকায় টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। একটি টিকাদান কেন্দ্রে ৬ জন কর্মী থাকবেন। এদের ২ জন টিকা দেবেন আর ৪ জন থাকবেন স্বেচ্ছাসেবক। নার্স, প্যারামেডিকস, অবসরপ্রাপ্ত টিকা প্রদানকারী, শিক্ষানবিশ চিকিৎসক, নার্সিং বিষয়ের শিক্ষার্থীরা এসব টিকা দেবেন।
স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে থাকবেন শিক্ষক, ক্লাবের সদস্যরা, জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত ছিলেন এমন লোকজন, ধর্মীয় নেতা (ইমাম, মুয়াজ্জিন), আনসার-ভিডিপির সদস্যরা। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে আলাদা টিম কাজ করবে। এ ছাড়া সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, সচিবালয় ক্লিনিক, সংসদ ক্লিনিক, বন্দর ক্লিনিকসহ অন্যান্য নির্ধারিত জায়গায় টিকাদান কেন্দ্র থাকবে। দেশের ৬৪ জেলা, ৪৯৩ উপজেলা ও ৪ হাজার ৬০০ ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশনগুলোর ৪৪৯ ওয়ার্ড, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালসহ অন্যান্য ক্লিনিকে মোট ১০ হাজার ৪০০ টিম কাজ করবে। প্রতি ইউনিয়নে দুটি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুটি, জেলা সদরে তিনটি এবং সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডে দুটি করে টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, সচিবালয় ক্লিনিক, সংসদ ক্লিনিক, বন্দর ক্লিনিকসহ অন্যান্য নির্ধারিত জায়গায় একটি করে টিকাদান কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি টিকাদান কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জনকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সরকার ২০২২ সালের জুনের মধ্যে দেশের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ১৪ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জনকে বিভিন্ন পর্যায়ে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। সবাইকে টিকা কার্ড দেওয়া হবে।
যেভাবে টিকা কেন্দ্রে পৌঁছাবে: উৎপাদক কোম্পানি থেকে বিমানযোগে দেশের বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হবে। এর পর বিমানবন্দর থেকে যাবে সরকারের নির্মাণ করা অথবা ভাড়া করা শীতল সংরক্ষণাগারে। এর পর সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সংরক্ষণাগারে। সেখান থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ইপিআই স্টোরে জমা রাখা হবে। এর পর যাবে টিকা কেন্দ্রে।
কে কোথায় টিকা পাবেন: প্রথম পর্যায়ে মোট জনসংখ্যার যে ১০ শতাংশকে টিকা দেওয়া হবে, তাদের কে কোথায় টিকা পাবেন তাও এ পরিকল্পনায় তুলে ধরা হয়েছে। সরাসরি করোনাভাইরাসের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬১ জন স্বাস্থ্যকর্মী সরকারি হাসপাতাল থেকে টিকা পাবেন। বেসরকারি খাত এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের ৭ লাখ, সরকারি ও বেসরকারি খাতের অন্যান্য দেড় লাখ এবং ২ লাখ ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধাও সরকারি হাসপাতাল থেকে টিকা পাবেন। ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৯ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সামরিক বাহিনীর সদস্য যারা ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করছেন, তারা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও পুলিশ হাসপাতাল থেকে টিকা পাবেন। এ দুই খাতের আরও ৩ লাখ ৮ হাজার ৭১৩ জন একই জায়গা থেকে টিকা পাবেন। সরকারের উচ্চপদস্থ ৫ হাজার কর্মকর্তা সচিবালয় ক্লিনিক, জেনারেল হাসপাতাল থেকে টিকা পাবেন। ৫০ হাজার সংবাদকর্মী টিকা পাবেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর বা জেনারেল হাসপাতাল এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে। ৬৮ হাজার ২৮৯ জনপ্রতিনিধি টিকা পাবেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর বা জেনারেল হাসপাতাল, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সংক্রমিত রোগ হাসপাতাল ও সংসদ ক্লিনিক থেকে। সিটি করপোরেশনের দেড় লাখ কর্মী টিকা পাবেন একইভাবে। ইমাম, মুয়াজ্জিন, মন্দির ও চার্চের ৫ লাখ ৬৮ হাজার ধর্মীয় নেতা সরকারি হাসপাতালগুলোতে টিকা পাবেন। এ ছাড়া ওয়াসা, ডেসকো, বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মী, ব্যাংকের কর্মী, অন্যান্য সংক্রমিত রোগ রয়েছে এমন রোগীরা প্রথম পর্যায়ে সরকারি হাসপাতাল থেকে টিকা পাবেন। প্রথম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে ৫৫ বছরের বেশি বয়স্ক নাগরিক, শিক্ষক ও শিক্ষা খাতের লোকজন, গার্মেন্ট কর্মী, পরিবহন কর্মী, আদিবাসী, যৌন কর্মী, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মীরা টিকা পাবেন।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয়: বিশাল এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৯ কোটি ৬৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬৮৮ ডলার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। পরিকল্পনা, সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ, তালিকা প্রণয়ন, প্রশিক্ষণ, সম্মানী, মনিটরিং, মূল্যায়ন, কোল্ড চেইন স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ, পরিবহন, সরবরাহ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজে এই ব্যয় হবে। এতে টিকা কেনার খরচ নেই। কারিগরি ব্যয়ও নেই।
রোহিঙ্গারা প্রথম ধাপে পাবে: কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ তা ব্যাপক ঘন বসতিপূর্ণ; যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০ হাজার লোক বসবাস করছে। রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে গড়ে ৪ দশমিক ৬ জন রয়েছে, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই রুমে থাকে। এই ঘন বসতিতে সামাজিক দূরত্ব বা আইসোলেশন রক্ষা করা খুবই কঠিন। রোহিঙ্গা জনগণের এই ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা কম। পানি, পরিস্কারকসহ অন্যান্য দ্রব্যেরও ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে টিকা দেওয়া শুরুর প্রথম পর্যায়েই সব রোহিঙ্গা টিকা পাবেন।
টিকা আমদানির শর্ত: টিকার উৎস ও কেনার শর্তের ওপর নির্ভর করবে আমদানির শর্ত। কোভ্যাক্স থেকে টিকা আমদানি করা হলে ওই টিকা যে দেশে উৎপাদন হয়েছে, সেখানে নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক। ওই টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের তালিকায় থাকতে হবে। এর পর বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হবে। সব ধরনের কাগজপত্র ঠিক থাকলে ছাড়পত্র দিতে ২ থেকে ৩ দিন লাগবে। কোভ্যাক্সের বাইরে অন্য কোনো কোম্পানি টিকা আমদানি করতে হলে সেই টিকা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্র্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান এবং ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সিতে নিবন্ধিত হতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী হতে হবে।
সেরা টিভি/আকিব