অনলাইন ডেস্ক:
এ যেন সিনেমাকেও হার মানায়। গল্পটি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় এক কিশোরের। যে কিনা ইন্টারনেটের নিষিদ্ধ জগতে বিচরণের মাধ্যমে, জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধমূলক কাজে। শেষমেষ হিন্দি মুভি “ধুম থ্রি” থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, নিজ শহর বগুড়ায় করেন ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা। সে চেষ্টা ব্যর্থ হলেও, তাকে ধরতে রীতিমত ঘাম ঝড়েছে পুলিশের বিশেষ টিমের।
গেল ৫ জানুয়ারি বগুড়া শহরের রুপালী ব্যাংকে ডাকাতির চেষ্টা হয়। আর এটি হয় একদম ফিল্মি স্টাইলে। যদিও শেষমেষ ডাকাতিতে ব্যর্থ হয় ১৬ বছর বয়সী সেই কিশোর। বাধা পেয়ে এসিড ও ছুরিতে আহত করে দুই নিরাপত্তারক্ষীকে। পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বাঁচতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে।
পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে ওই কিশোর জানায়, হিন্দি সিনেমা “ধুম থ্রি” দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে সে। পরিকল্পনা ঠিক করতে সিনেমাটি দেখেছে ১৫৪ বার।
বগুড়া জেলার ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র ছেলে কৌশিক। মেধাবী ছেলে কৌশিক বেশ চতুর। স্কুলেও ছিলো ভালো শিক্ষার্থী, বিজ্ঞানেও ছিলো পারদর্শী। বিজ্ঞানের প্রতি তার আগ্রহ ব্যাপক। কিন্তু এতকিছুতে লাভ হয়নি, আলোর নিচেই যেন অন্ধকার। স্কাউটে রাষ্ট্রপতি পদকও পেয়েছিলো কৌশিক। কিন্তু সেই ছেলেই এখন কথিত অ্যাডভেঞ্চারের নামে ঝুঁকিপূর্ণ অপরাধে জড়িয়েছে।
নিষিদ্ধ ডার্কওয়েব জগতে বিচরন করে সে নামে ব্যাংক ডাকাতিতে। ঘটনার ১৮ দিন পেরুলে ধরা পড়ে কৌশিক। তারপর পুলিশদের কাছে নানান সব ভয়ংকর তথ্য প্রকাশ করেছে সে। তার কাছে সেসব তথ্য শুনে অবাক হয়েছেন পুলিশের অপরাধ বিশেষজ্ঞ টিম।
ডার্কনেট বা ডার্কওয়েব হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির গোপন জগৎ বা ডিপ ওয়েবের এমন একটি অংশ, যেখানে সব রকম অবৈধ কার্যকলাপ সংঘটিত হয়। ডার্কওয়েবে নিজের পরিচয় গোপন রেখে খুব সহজেই অপরাধ জগতে বিচরণ করা যায়। সমস্ত অপরাধমূলক কাজ ও নিষিদ্ধ কাজগুলো করা যায়।
কৌশিক জানায়, হ্যাকিং গ্রুপের মেম্বার হয়েছে সে। তার ৫২ টি ফেইক ফেসবুক আইডি রয়েছে ও ২২ টি ফেইক ইমেইল রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমেই সারা দুনিয়ার সাইবার অপরাধীদের সাথে সে যুক্ত আছে।
ছোটবেলা থেকেই তার সাইবার অপরাধ নিয়ে বেশ আগ্রহ। মাত্র ১৪ বছর বয়সে, ২০১৬ সালে ডার্কওয়েবে প্রাপ্ত একটি লিংকের মাধ্যমে কৌশিক বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি মোবাইল ফোনের প্রধান সার্ভার হ্যাক করে। পুলিশের কাছে সে স্বীকার করে, ওই কোম্পানি হ্যাকের পর আট ঘন্টা তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলো।
কৌশিক জানায়, অ্যাডভেঞ্চারের একটি অংশ হিসেবে সে ব্যাংক ডাকাতি করে। ভিজুয়্যাল ইফেক্ট ব্যবহার করে নির্মিত বলিউড মুভি ধুম থ্রি দেখেই তার ব্যাংক ডাকাতি পরিকল্পনা সম্পূর্ণ হয়। এজন্য মুভিটি তাকে ১৫৪ বার দেখতে হয়েছে। যদিও মুভিটির শুরুতেই বলা ছিল এটিতে ঝুঁকি রয়েছে কেউ নকল করার চেষ্টা করবেন না।
ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস (ভিএফএক্স) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে চিত্রগ্রহণটি চলচ্চিত্র তৈরির একটি লাইভ-অ্যাকশন শটের প্রেক্ষাপটের বাইরে তৈরি করা হয়। আর মূলত ধুম থ্রিতে এরকম ভিজুয়্যাল ইফেক্ট ছিলো। আর সেটি দেখেই ব্যাংক ডাকাতির ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চারের নেমে পড়ে। গত ৫ জানুয়ারি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার একটি রুপালি ব্যাংকের শাখায় দুই প্রহরীকে নিক্ষিপ্ত দাহ্য পদার্থ ও ছুরিঘাতে আহত করে ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা করে।
ডাকাতির জন্য ভোরবেলা সে মুখে মুখোশ ও হাতে রুপটপ গ্লোভস পড়ে ছাদে উঠে পড়ে। এই গ্লোভস পড়লে ছাদে উঠতে মই লাগেনা। স্পাইডারম্যানের মতো সে উপরে উঠে ও কাটার দিয় ছাদের সিঁড়ি ঘরের তালা কেটে ভিতরে ঢুকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভিতরের ভল্ট ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয় সে। এই ঘটনার ১৮ দিন পর পুলিশের বিশেষ একটি টিম তাকে গ্রেফতার করে।
কৌশিকের আরও একটি অন্ধকার দিক ছিল নিউক্লিয়ার সায়েন্স (পরমাণু বিজ্ঞান) নিয়ে পড়াশোনা। অনলাইনের ডার্কওয়েবের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত নিষিদ্ধ বই তার সংরক্ষণে রেখেছিলো। একইসঙ্গে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির জন্য সে থিসিস নোট লিখে ডার্কওয়েবের মাধ্যমে জমা দিত। তার একটি ২৩ পাতার আর্টিকেল ও তিন পাতার নকশা ডার্কওয়েবের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে আট হাজার ডলারে বিক্রি হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি। দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকে তার মায়ের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কৌশিক এই টাকা তুলে নেয়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভুঞা জানান, একজন কিশোর এতো ভয়াবহ অপরাধের পরিকল্পনা নিয়ে চলতে পারে তা ভেবে তারা অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, তার বাবা মার সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, ছেলে বখাটে হয়ে গেছে তাদের কথা শুনেনা। তবে কৌশিকের অপরাধ জগতের কোনো ব্যাপারে তারা মন্তব্য করেননি।