বাবুল সিদ্দিক:
মার্কিন ঔপন্যাসিক অ্যালেক্স হেলী। ৭০ বছর বয়সে ১৯৯২ সালে মৃত্যু বরন করেন তিনি। কথায় আছে কীর্তিমানের মৃত্যু নাই। একজন শিল্পীও তেমন। একজন শিল্পী তার মৃত্যুতেই নিঃশেষ হয়ে যান না মানুষের মানষলোক থেকে। শিল্পীরা বেঁচে থাকে যুগ যুগ ধরে তার সৃষ্টির মাধ্যমে। মহাকাল সযত্নে লালন করে তাদের কীর্তি । ‘ রুটস ‘(Roots: The Saga of an American Family, সংক্ষেপে: রুটস) যাতে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন আমেরিকার কালো মানুষদের কয়েক শতাব্দীর নির্মম নিপীড়ন,বঞ্ছনা আর যন্ত্রণাদীণ জীবন কাহিনী। ‘রুটস ‘ একটি জাতীর দাসত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভের এক সত্যসন্ধ চমকপ্রদ দলিল । জাতীসত্তার উৎস সন্ধানী একজন লেখকের এক যুগের গবেষনা ও অনুসন্ধানের ঐতিহাসিক তথ্য সম্বলিত অসাধারন স্মৃতিকথা। অন্যদিকে এই উপন্যাসের মহাকাব্যিক পরিসরে অবয়ব পেয়েছে এক বৃহৎ পরিবারের বংশানুক্রনিক কিংবদন্তী।
১৯৩৯ সালে সতেরো বছর বয়সে অ্যালেক্স আমেরিকার কোস্ট গার্ডে মেস বয় হিসাবে যোগ দেন। দীর্ঘ দশ বছর তিনি কোস্ট গার্ডে কাজ করেন।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাস্র নিয়ে তাদের জাহাজ প্রায়ই দক্ষিন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যাতায়াত করত। সে সময় হেলী বিভিন্ন স্থানে ঘোরার সুযোগ পান। সমুদ্রযাত্রার একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি তখন লেখালেখি শুরু করেন। তার সংগে থাকত একটি বহনযোগ্য টাইপ রাইটার। সেই ক্লান্তিকর, নিরান্দময় দিনগুলো জাহাজের লাইব্রেরির বই এবং টাইপ রাইটার ছিল হেলীর অন্যতম সঙ্গী। ’রুটস্ ‘ রচনার পরিকল্পনা এ সময়ই তার মধ্যে জেগেছিল।
১৯৫৯ সালে কোস্ট গার্ডের চাকুরী থেকে অবসর গ্রহনের পর হেলী নিয়মিত লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। সে সময় কয়েকটি পত্রিকা তার লেখা প্রকাশ করে উৎসাহ যুগিয়েছিল। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ দি অটোবায়োগ্রাফী অব ম্যালকম এক্স ‘।’ রুটস ‘ এর কিছু অংশ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ রিডার ডাইজেস্ট ‘ পত্রিকায় ১৯৭৪ সালে। মোট ৩৭ টি ভাষায় অনুদিত এই উপন্যাসের জন্য হেলী পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করেন ১৯৭৭ সালে।উপন্যাসটির টিভি সিরিয়াল নির্মিত হয় এবং সারা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
অ্যালেক্স হেলী কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের বংশধর। পূর্ব পুরুষদের জীবনকথা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে দীর্ঘ বার বছর তিনি অতিবাহিত করেছেন পারিবারিক ইতিহাসের তথ্য অনুসন্ধানে,যা ‘রুটস’উপন্যাসের অন্যতম উপাদান। ছয় প্রজন্মের ইতিহাস তিনি উদঘাটন করেছেন, যারা আদিতে ছিল কৃতদাস এবং যাদের আদি বাসভুমি ছিল আফ্রিকা এই প্রাচিন ইতিহাসকে তিনি নিংড়ে তুলেছেন আদিম জীবনের গহীন প্রকোস্ট থেকে।অভিজ্ঞতা সন্চয়ের জন্য তাকে প্রবেশ করতে হয়েছে কালো চামরার মানুষদের সার্বিক জীবেনযাত্রা পদ্ধতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেই জীবনকে কাছ থেকে প্রতক্ষ করার জন্য আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে হেলী এক দুসাহসী সমুদ্র অভিযানে প্রবৃত্ত হন। দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মহাদেশ ঘুরে ঘুরে হেলী তার পূর্ববর্তী ছয় পুরুষের প্রকৃত জীবন তথ্য সংগ্রহ করেন। হেলীর জ্বলজ্যান্ত অভিজ্ঞতাই ‘ রুটস্ ‘ এর প্রেক্ষাপট। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে সমগ্র কাহিনী রূপায়িত হয়েছে। বিষয়বস্তুর অসাধারন বক্তব্যের বলিষ্ঠতা সর্বোপরি আদিবাসীদের জীবন চর্যার বিবরণে সমৃদ্ধ এবং মানবজীবনের আদিম কামনা- বাসনা মূরত হয়ে এপিক উপন্যাস ‘রুটস্ ‘ আমেরিকার সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ক্লাসিক গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে, একই সঙ্গে সার্বজনীন ও সর্বকালীন সাহিত্যের আসরে স্থান পেয়েছে।
হেলীর অভিজ্ঞতার মূল উৎস তার শৈশবের স্মৃতি, যখন তিনি এবং তার মা হেনিং- এ থাকতেন মাতামহীর সঙ্গে। তার মাতামহীর পরিবারে আরও ছিলেন হেলীর খালা প্লাজ,লিজ,টিল এবং খালাত বোন জর্জিয়া। ঘরের দাওয়ায় বসে রূপকথার গল্পের মতই তিনি মাতামহীর কাছে শুনতেন পুরানো দিনের গল্প কাহিনী। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতো – দোলানো চেয়ারে বসেই সেই পৌঢ় পান্ডুর মুখে অতিতের স্মৃতি চারণ করে যেতেন, বলতেন তাদের পূর্ব পুরুষদের কথা। তারা ছিল উপনিবেশের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত দাস। সাদা চামরার মানুষদের কাছে তারা গন্য হতো নিতান্ত নিম্নশ্রেনির জীব বলে। টুকরো টুকরো ঘটনা, খন্ড খন্ড জীবন- কথা সবিস্তারে তারা বর্ননা করতেন আবেগাপ্লুত কন্ঠে। হেলী বিস্মিত হয়ে মনোযোগ সহকারে শুনতেন সেসব কথা। তাদের বংশের আদি পুরুষদের তারা ‘ আফ্রিকন’ বলে অভিহিত করতেন। আফ্রিকানরা কিভাবে দাসত্ব বরণ করেছিল, সেসব করুন ও হৃদয় বিদারক কথা হেলী তার নানীমা ও খালাদের কাছ থেকে জেনেছিলেন।
আদি আফ্রিকানকে প্রথমে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ন্যাপলিস নামক স্থানে এবং দাস হিসাবে বিক্রি করা হয় ভার্জিনিয়ায়। সেখানে অন্য এক কৃতদাসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তারপর তার একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়, নাম ছিল কিজি। এই কিজির বয়স যখন চার/পাঁচ বছর হয়, তখন তার বাবা মেয়েটির ব্যাপারে সচেতন ও মনোযোগী হন। তিনি মেয়েটিকে নিজের মাতৃভাষার সঙ্গে পরিচিত করাবার জন্য ঐ ভাষায় সব জিনিষের নাম বলে দিতেন। তাদের বাসস্থানে পাস দিয়ে যে নদী বয়ে যেত আফিকান ভাষায় তার নাম ছিল ‘ক্যাম্বী বুলোঙ্গ ‘। শুধু তাই নয় অন্য ক্রীতদাসরা যখন ‘ টবি’ নামে সম্বোধন করত— সেই আফ্রিকান প্রবল প্রতিবাদের সঙ্গে জানাতেন যে তার নাম ‘ কিনটে ‘। কিনটে মাঝে মাঝে মেয়ে কিজিকে নিজের অতিতের কাহিনী শোনাতেন। আফ্রিকার নিজের গ্রামে অবস্হান কালে একদিন তিনি ডাম বানানোর জন্য বনে কাঠ কাটতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে চারজন লোক তাকে ধরে এনে দাস হিসাবে বিক্রি করে। সেই থেকে তার দাস জীবনের শুরু।
বড় হয়ে কিজি তার ছেলেকে এসব কাহিনী শোনাত এবং সেই ছেলে আবার তার ছেলে মেয়েদের তা বলতো। কিজির ছেলের দৌহত্রী ছিলেন হেলীর মাতামহী। গল্পের ছলে তিনি এই কাহিনী গুলি শোনাতেন হেলীকে। এভাবেই হেলী আফ্রিকানদের প্রাচিন ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হন এবং তার পরিবারের বংশানুক্রমিক ক্রমবিকাশ থেকে শুরু করে কিভাবে তারা গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষন থেকে মুক্তি লাভ করে – তা জানতে পারে। এই কাহিনীগুলো হেলীর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। মাতামহীর কাছে শোনা নিজের পরিবারের ইতিহাসের কাহিনী তার স্মৃতিতে অম্লান ও জীবন্ত ছিল। সে সব টুকরো কাহিনী গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার সংকল্প গ্রহন করে তিনি তথ্যসংগ্রহে প্রবৃত্ত হন। ১৯৬২ সালে অন্যান্য কাজের মাঝে জড়িত থেকেও তিনি প্লানটেশন রেকর্ড,উইল এবং আদম শুমারির তালিকা থেকে এখানে ওখান ছডিয়ে থাকা দলিল পত্র সংগ্রহ করেন। ইতোমধ্যে তার মাতামহী মৃত্যু বরণ করেন। হেলী তখন অন্যান্য আত্মীয়স্বজনর কাছে যান। প্রবীনদের মধ্যে একমাত্র বষীয়সী খালাত বোন জর্জিয়া তখনো বেঁচে ছিলেন,তিনি পরিবারের ইতিহাসের অনেক কিছুই যানতেন।
হেলী তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘আওয়ার এনসাইক্লোপেডিয়া ম্যাট্রিয়াচ।’ তিনি প্রায়ই তার কাছে যেতেন ক্যানসাস শহরে। এছাড়া ওয়াশিংটন ন্যাশনাল আর্কাইভ, কংগ্রেস লাইব্রেরি এবং আমেরিকান রেভুলেশন লাইব্রেরির শাখায় যেতেন তথ্য সংগ্রহের সন্ধানে। ১৯৬৭ সাল নাগাদ হেলী আমেরিকার কাছাকাছি সাত পুরুষ পর্যন্ত প্রমাণ্য দলিল ও তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। কিন্তু আদি আফ্রিকানদের উচ্চারিত অদ্ভুত ও অজানা ধ্বনিগুলি সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট কোন ধারনা না থাকায় বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। নিউইয়র্কে থাকাকালে তিনি প্রায়ই জাতিসংঘ লবিতে গিয়ে আফ্রিকানদের সেই ধ্বনিগুলির মর্মার্থ জানতে চাইতেন। কিন্তু কেউ তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারত না। শেষ পর্যন্ত আফ্রিকান ভাষায় পারদরশী একজন ভাষাতত্ববিদ তাকে উক্ত ধনিগুলোর মর্মার্থ বুঝিয়ে দেন। ‘ কিনটে ‘ ধ্বনিটি ম্যান্ডিনকা উপজাতির গোত্র নাম এবং ‘ ক্যামি বুলোঙ্গ ‘ শব্দটি সম্ভবত ম্যান্ডিনকা উপভাষায় গাম্বিয়া নদীর নাম। এই তথ্য জানার পর হেলী চলে যান আফ্রিকায়।
গাম্বিয়ার রাজধানী ব্যাজ্ঞুলে গিয়ে তিনি কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করেন। তারা তাকে জানায়,কিভাবে প্রাচিন আফ্রিকার বংশানুক্রমিক ও কালক্রমিক ইতিহাস সেখানে সংরক্ষিত হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাচীন গ্রামগুলোতে তখনও কিছুসংখ্যক প্রবীন লোক বাস করত-তাদের বলা হতো ‘ গ্রিয়টস‘। এরা অনেক কিছু জানত এবং বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে নিজ গোত্র, পরিবার,ও গ্রামের ইতিহাসের পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা দিয়ে যেত। হেলীর পূর্বপুরুষরা কিনটে নামে নিজেদের পরিচয় দিতেন। কিনটে গোত্রের নাম গান্বিয়াতে বেশ পরিচিত ছিল। তাই তারা তাকে সবরকম সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতি দেয়।
হেলী নিউইয়র্কে ফিরে যাবার পর গাম্বিয়া থেকে একটা চিঠি পান।তাকে জানানো হয় যে,সেখানে এক গ্রামে কিনটে গোত্রের একজন গ্রিয়টস এর সন্ধান পাওয়া গেছে। তার নাম ‘ কেব্বা কানজি ফোফান’। হেলী গাম্বিয়ায় ছুটে আসেন এবং সেই গ্রিয়টস এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এই সাক্ষাৎকার ছিল আনুষ্ঠানিক ধরনের এবং হেলীর জীবনের একটি স্মরনীয় ঘটনা। সেই আবেগঘন মূহুর্ত তার জীবনে দ্বিতীয়বার আসে নি। এই প্রথমবারের মত তিনি পশ্চিম আফ্রিকার শহরতলী জাফার নামক এক গ্রাম যান। তাদের চৌদ্দ জনের সাফারি দলটি যখন গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছায়, গোলাকৃত মাটির কুঁড়েঘর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক এসে তাদের স্বাগত জানায়। দূর থেকে হেলী টুপি পরিহিত বিবণ পোষাকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির একজন বৃদ্ধকে দেখতে পান,সমস্ত পরিবেশের পরিপ্রক্ষিতে তাকে বিশিষ্ট কেউ বলে মনে হয় না। সেই কালো মানুষগুলো হেলীকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে দাঁড়াল। বৃদ্ধ লোকটি তার দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকালেন এবং ম্যান্ডিনকা ভাষায় কথা বললেন। হেলীর সঙ্গে দোভাষী ছিল। বৃদ্ধ বললো যে, তার পূর্ব পুরুষরা বলে গেছেন, বহু আফ্রিকান আমেরিকা নামক স্থানে কৃতদাসরূপে নির্বাসিত আছেন। তারপর সেই ৭৩ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ বলে গেলেন কিনটে গোত্রের সুদীর্ঘ বংশানুক্রমিক ইতিহাস। গ্রামবাসীদের জন্য এটা একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার ছিল এবং তারা শান্ত ভাবে উপভোগ করছিল। গ্রিয়ট অনর্গল বলে চললেন—দুই বা তিন শতাব্দী পূর্বে কে কাকে বিয়ে করেছিল এ সব কথা। বর্ণনার প্রাচুর্যে এবং বাইবেলীয় ঢং-এ তার কথা বলার ভঙ্গি হেলীকে অভিভূত করে। তার কথা গুলো ছিল এ ধরনের —অমুকের পুত্র ছিল অমুক -তার পুত্র অমুককে বিয়ে করে। তারা অমুক স্থান থেকে অমুক স্থান যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইভাবে একটানা কয়েক ঘন্টা গ্রিয়ট প্রায় ১৭৫০ সন পর্যন্ত কাহিনী বলে গেলেন এবং দোভাষীর মাধ্যমে হেলী তা বুঝে নেন। তার পর গ্রিয়ট বললেন,” যখন রাজার সৈন্যরা এলো,ওমরোর চার ছেলের মধ্যে বড় যে কুনটা, সে এই গ্রাম থেকে চলে গিয়েছিল কাঠ কাটতে কিন্তু তাকে আর দেখা যায় নি।” এ কথা শোনার পর হেলীর কাছে সব কিছু কেমন যেন ঘোলাটে মনে হয়। কারন হেনিং – এর দেওড়ীতে বসে মাতামহীর কাছে শোন গল্পগুলি তিনি ভোলেন নি। আফ্রিকানদের পূর্ব পুরুষদের সম্পর্কে যে সব তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছিলেন,তা তার নোটবুকে ছিল। তিনি নোটবুক বের করে দোভাষীকে দেন। তারা সেটা বৃদ্ধ গ্রিয়টকে দেখান। তৎক্ষনাৎ বৃদ্ধ উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং তার লোকদের কাছে গিয়ে কি যেন বললেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। হেলী তখন মহা মুশকিলে পরে যান। এদিকে সেই সত্তরজন কুশ্রী লোক তাকে ঘিরে ধরল। হেলী ভীষন বিপন্ন বোধ করলেন। একজন মহিলা সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসে। ঘোর কৃষ্ণবর্ণের মহিলাটি চোখে মুখে ভ্রুকুটি করে আক্রমণের ভঙ্গিতে হেলীর দিকে এগিয়ে আসে এবং তার শিশুকে বিশ্রীভাবে তার দিকে ঠেলে দেয়। হেলী বাচ্চাটিকে আঁকড়ে ধরেন। সঙ্গে সঙ্গে মহিলা শিশুটিকে কেড়ে নেয়। একইভাব পর পর কয়েক জন মহিলা তাদের শিশুদের হেলীর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার নিয়ে নেয়।
এই ঘটনার এক বছর পর হাভার্ড – এর একজন খ্যাতনামা প্রফেসর হেলীকে বলেছিলেন,ওই ঘটনাটি ছিল আফ্রিকানদে আদিমতম উৎসবের একটি পর্ব। শিশু সন্তানদের দেয়া নেয়ার মধ্যদিয়ে তারা বুঝিয়েছিল, তাদের এবং তার (হেলীর) একই রক্ত বহমান – সকলেই একই উৎস থেকে এসেছে। পরবর্তী পর্য্যায় তাদের সাথে শহরতলীর পথ দিয়ে যেতে যেতে তিনি ড্রামের মধুর বাজনা শুনতে পান। তারা তখন অন্য একটা গ্রামে পৌঁছান, চারিদিক থেকে কালো লোকেরা দলে দলে ছুটে এসে ভিড় জমায় ধুলধুসরিত পথে এবং হেলী যতই তাদের নিকটবর্তী হতে থাকেন, তার কানে বাঁজতে থাকে তাদের তুমুল হরষধ্বনি। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন ল্যান্ডরোভারে করে তাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ান, তখন বুঝতে পারলেন তারা সবই চিৎকার করে বলছে – – “মিস্টার কিনটে ,মিস্টার কিনটে।” অর্থাৎ তাদের চোখে তিনিই ছিলেন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রতিক, যাদের পুর্ব পুরুষদের ক্রিতদাস করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আফ্রিকা থেকে।
হেলী সহ্য করতে পারলেন না এই আবেগঘন দৃশ্য। দুহাতে মুখ ঢেকে তিনি কাঁদতে থাকেন যা তার জীবনে আর কখনো ঘটেনি। ওই রকম মূহুর্তে কান্না ছাড়া তার পক্ষে আর কিছুই হয়তো করার ছিল না। তারপর হেলী লন্ডনে যান.সেখানে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন এবং অবশেষে ব্রিটিশ পারলামেন্টারী রেকর্ড থেকে উদ্ধার করেন সেই তথ্য,যা আফ্রিকান গ্রিয়ট তাকে ‘রাজসৈনিক’ বলেছিলেন। তার উল্লেখিত ‘রাজ সৈনিকদের ‘ একটি দল যারা কর্নেল ওহেয়ার বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। ১৭৬৭ সনে ব্রিটিশ শাসিত ‘জেমস ফোর্ড ‘ নামক ক্রীতদাসদের একটি দূর্গের গার্ডরূপে এই সেনাবাহিনীকে গাম্বিয়া নদী পথে পাঠানো হয়েছিল। এরপর হেলী লন্ডনের লিয়ডস- এ যান। সেখানে তার জন্য রিসার্চের সবরকম পথ উন্মুক্ত ছিল। তিনি পুরানো মেরিটাইম রেকর্ডসমূহ খুঁজে দেখতে থাকেন। আফ্রিকা থেকে যে দাসদের নিয়ে যে সব জাহাজ এসেছিল আমেরিকায়, সেগুলোর প্রতি তার মনোযোগ স্থির ছিল। সেই রেকর্ডগুলো বিভিন্ন ভলিউম এ রক্ষিত ছিল।
হেলীর অনুসন্ধানের সপ্তম সপ্তাহে একদিন অপরাহ্ন প্রায় ২-৩৪ মিনিটে যখন তিনি উক্ত রেকর্ডসমূহের এক হাজার তেইশতম সেট পরীক্ষা করে দেখছিলে, তখন তার হাতে পড়ল একটি শিট, যাতে লেখা ছিল ত্রিশটি দাস— জাহাজের গতিবিধি রিপোর্ট। তার চোখ স্হির হয়ে রইল ১৮ নম্বর- এ, দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল লেখাগুলিতে। একটি জাহাজ ১৭৬৭ সনে গাম্বিয়া নদী থেকে সরাসরি আমেরিকার পথে পাড়ি দিয়েছিল। জাহাজটির নাম ‘ লর্ড লাইগোনির ‘ এবং সেটি ১৭৬৭ সনের ২৯ সেপ্টেম্বর এনাপলিস(ন্যাপলিস) নামক স্থানে পৌঁছায়। ঠিক দু’শ বছর পর ১৯৬৭ সনের ২৯ সেপ্টেম্বর এনাপলিসের একটি জেটিতে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন হেলী – যে পথ বেয়ে তার আদি পূর্ব পুরুষদের নিয়ে আসা হয়ে ছিল। এ ছাড়া তিনি কীইবা করতে পারতেন ! এই এনাপলিস নামক স্থানেই মেরিল্যান্ড গেজেট- এর মাইক্রো ফিল্মিমড রেকডগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলেন: ১৭৬৭ সনের ১ অক্টোবর সংখ্যা তৃতীয় পৃষ্ঠায় একটি নিলাম বিজ্ঞপ্তি ছিল — ‘দ্যা লর্ড ল্যাগোনিয়ার হ্যাভ জাস্ট এরাইভ ফ্রম দ্যা রিভার গাম্বিয়া উইথ এ কার্গো অব চয়েস,হেলদী স্লেভস, টু বি সোল্ড এট অকশন দ্যা ফলোয়িং ওয়েডনেসডে।’