হিসাব করে দেখি আমাদের কাছে এক টাকার মত আছে - বঙ্গবন্ধু - Shera TV
  1. [email protected] : akibmahmud :
  2. [email protected] : f@him :
হিসাব করে দেখি আমাদের কাছে এক টাকার মত আছে - বঙ্গবন্ধু - Shera TV
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫৯ পূর্বাহ্ন

হিসাব করে দেখি আমাদের কাছে এক টাকার মত আছে – বঙ্গবন্ধু

সেরা টিভি
  • প্রকাশের সময় : সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১
এই সময় ছাত্রদের মধ্যে বেশ শক্তিশালী দুইটা দল সৃষ্টি হয়। আমি কলকাতায় এসেই খবর পেলাম,আমাদের দিল্লী যেতে হবে ‘ অল ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগ সম্মেলনে’ যোগদান করতে। তোরজোর পরে গেল। যারা যাবেন তাদের নিজের টাকায়ই যেতে হবে। আনোয়ার হোসেন সাহেব তার দলবল থেকে কয়েকজনকে নিলেন। টাকাও বোধহয় যোগাড় করলেন। আমি ও ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি মীর আশারাফউদ্দিন ঠিক করলাম, আমরা যাব আমাদের নিজের টাকায়। আমাদের পূর্বেই ডেলিগেট করা হয়েছিল। মীর আশরাফউদ্দিন ওরফে মাখন, বাড়ি ঢাকা জেলার মুন্সিগন্জ মহকুমার কাজী কসবা গ্রামে। আমার খালাত বেনের ছেলে,ওর বাবা- মা ছোটবেলায় মারা গেছে। যথেষ্ট টাকা পয়সা রেখে গেছেন। ওর বাবা তখনকার দিনে ডেপুটি ম্যাজেস্ট্রেট ছিলেন ।শহীদ সাহেবকে বল্লাম,” আমরা দিল্লি কনফারেন্সে যোগদান করবো।

” তিনি বললেন, “ খুব ভাল, দেখতে পারবে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমান নেতাদের।” আমরা দু’জন ও আনোয়ার সাহেবের দলের কয়েকজন একই ট্রেনে ভিন্ন ভিন্ন কামরায় রওয়ানা করলাম।তাদের সাথে আমাদের মিল নাই। দুই মামু-ভাগ্নের যা খরচ লাগবে দিল্লিতে, তা কোন মতে বন্দোবস্ত করে নিলাম। টাকা বেশি প্রয়োজন হলে আমি আমার বোনের কাছ থেকে আনতাম। বোন আব্বার কাছ থেকে নিতো। আব্বা বলেদিয়েছিলেন তাকে, আমার দরকার হলে টাকা দিতে। আব্বা ছাড়াও মা-এর কাছ থেকেও টাকা নিতে পারতাম।আর সময় সময় রেনুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেনু যা কিছু যোগাড় করতো বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোন দিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত,আমার জন্যই রাখত।

হাওড়া থেকে আমরা দিল্লিতে রওয়ানা করলাম। এই প্রথমবার আমি বাংলাদেশের বাইরে রওয়ানা করলাম। দিল্লি দেখার একটা প্রবল আগ্রহ আমার ছিল। ইতিহাসে পড়েছি,বন্ধু বন্ধবদের কাছ থেকে শুনেছি,তাই দিল্লির লাল কেল্লা,জামে মসজিদ,কুতুব মিনার ও অন্যান্য ঐতিহাসিক জায়গাগুলো দেখতে হবে। নিজামউদ্দিন আওলিয়ার দরগায় যাবো। আমরা দিল্লি পৌছলে মুসলিম লীগের সেচ্ছা সেবক দল আমাদের পৌছে দিল এ্যাংলো এ্যারাবিয়ান কলেজ প্রাঙ্গনে। সেখানে আমাদের জন্য তাঁবু করা হয়েছে।তাবুতে আমরা দুই জন ছাড়াও আলীগড়ের একজন ছাত্র এবং আর একজন বোধ হয় এলাহাবাদ বা অন্য কোথাকার হবে। আনোয়ার সাহেবর দলবল অন্য একটি তাবুতে রইলেন। বিরাট প্যান্ডেল করা হয়েছে। আমরা ডেলিগেট কার্ড নিয়ে সভায় উপস্থিত হলাম। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়েছে।

প্রথম দিন কনফারেন্স হয়ে যাওয়ার পরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হাতির পিঠি নিয়ে এক বিরাট শোভা যাত্রা হল।আমরাও সাথে সাথে রইলাম।লোকে লোকারণ্য, রাস্তায় রাস্তায় পানি খাওয়ার বন্দবস্ত রেখেছে।বোধহয় এ সময় পানি না রাখলে বহু লোক মারা যেত।দিল্লির পুরানো শহর আমরা ঘুরে বিকেলে ফিরে এলাম। রাতে আবার কনফারেন্স শুরু হল। এই সময়কার একজনের কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। উর্দুতে তিন ঘন্টা বক্তৃতা করলেন। যেমন গলা তেমনি বলার ভঙ্গি। উর্দু ভাল বুঝতাম না,কোলকাতার উর্দু একটু বুঝলেও এ উর্দু বোঝা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর। বক্তৃতা করছিলেন ইয়ার জং বাহাদুর। তিনি হায়দ্রাবাদের লোক ছিলেন। স্টেট মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তার বত্তৃতা না বুঝলেও সভা থেকে উঠে আসা কষ্টকর ছিল।

শরীর আমার খারাপ হয়ে পড়ে। দিনের বেলায় ভীষন গরম,রাতে ঠান্ডা। সকালে আর বিছানা থেকে উঠতে পারি নাই।বুকে,পেটে আর সমস্ত শরীরে বেদনা। দুই তিন দিন পায়খানা হয় নাই। অসহ্য যন্ত্রনা আমার শরীরে। দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে শুয়েই রইলাম। মাখন আমার কাছেই বসে আছে। ডাক্তার ডাকতে হবে,কাউকেই চিনি না,জানি না। একজন সেচ্ছাসেবককে বলা হল, তিনি বললেন,” আভি নেহি ,থোরা বাদ”। তাকে আর দেখা গেলো না,’থোড়া বাদই রয়ে গেলো।’ বিকেলের দিকে মাখন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমারও ভয় হল। এই বিদেশ কি হবে ? টাকা পয়সাও বেশী নাই। মাখন বললো,”মামা আমি যাই ডাক্তার যেখানে পাই, নিয়ে আসতে চেষ্টা করি।

এভাবে থাকলে তো বিপদ হবে।” শহীদ সাহেব কোথায় থাকেন জানি না,অন্য নেতাদের বলেও কোন ফল হয় নাই।কে কার খবর রাখে ? মাখন যখন বাইরে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় দেখি হেকিম খলিলুর রহমান আমাকে দেখতে এসেছেন। তিনি জানেন না,আমি অসুস্থ। খলিলুর রহমানকে আমি ‘খলিল ভাই’ বলতাম। ছাত্রলীগের বিখ্যাত কর্মী ছিলেন।আলীয়া মাদ্রাসায় পড়তেন এবং ইলিয়ট হোস্টেলে থাকতেন।

ইলিয়ট হোস্টেল আর বেকার হোস্টেল পাশাপাশি, আমরা ঠাট্টা করে বলতাম,’ইডিয়ট’ হোস্টেল। খলিল ভাই মাদ্রাসা পাস করে এসেছেন এক বৎসর পূর্বে, হাকিম আজমল খাঁ সাহেবের হেকিমি বিদ্যালয়ে হেকিমি শেখবার জন্য। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, কি সর্বনাশ,কাউকে খবর দাও নাই ! তিনি মাখনকে বল্লেন,”আপনার ডাক্তার ডাকতে হবে না,আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি।” আধ ঘন্টা পরে খলিল ভাই একজন হেকিম নিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি আমাকে ভালভাবে পরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিলেন। তাঁকে খলিল ভাই পূর্বেই আমার রোগের কথা বলেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন,” ভয় নাই। ওষুধ খাওয়ার পরে তিনবার আপনার পায়খানা হবে,রাতে আর কিছুই খাবেন না। ভোরে এই ওষুধটা খাবেন। বিকেলে আপনি ভাল হয়ে যাবেন।” তিনি যা বললেন তাই হল।

পরের দিন সুস্থ বোধ করতে লাগলাম। কনফারেন্সও শেষ হয়ে যাবে।খলিল ভাই আমার সাথেই দুই দিন থাকবেন। আমরা দিল্লির সকল কিছু ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এ সময় আর একটা ঘটনা ঘটল। বরিশালের নুরুদ্দিন এর সাথে আনোয়ার সাহেবের ঝগড়া হয়েছে। নুরউদ্দিন রাগ করে আমাদের কাছে চলে এসেছে। তার টাকা পয়সা আনোয়ার সাহেবের কাছে। তাকে কিছুই দেয় নাই। একদম খালি হাতে আমার আর মাখনের কাছে এসে হাজির।বলল, “না খেয়া মরে যাব,দরকার হয় হেঁটে কোলকাতা যাব তবু ওর কাছে আর যাব না।”এই নুরউদ্দিন সাহেবকেই মাখন ইসলামিয়া কলেজ ছত্র ইউনিয়নের ইলেকশনে জেনারেল সেক্রেটারি পদে পরাজিত করেছিল। নুরউদ্দিনকে ছাত্ররা ভালবাসতো কিন্তু সে আনোয়ার সাহেবের দলে ছিল বলে তাকে পরাজিত হতে হয়েছিল। আই,এ পড়লেও দলের নেতা আমিই ছিলাম। আমরা একই হোস্টেলে থাকতাম। বললাম, “ ঠিক আছে তোমার ওর কাছে যাওয়া লাগবে না,যেভাবে হয় চলে যাবে।” যদিও ওর জন্য টিকিট করার টাকা আমাদের কাছে নাই। তিন দিন থাকব ঠিক হলো। খাবার খরচ বেশী,হোটেলে খেতে হয়। দু’দিনের মধ্যেই দিল্লীর লাল কেল্লা,দেওয়ানি আম,দেওয়ানি খাস,কুতুব মিনার,নিজামউদ্দিন আওলিয়ার দরগাহ্,নতুন দিল্লি দেখে ফেললাম। কিছু টাকা খরচ হয়ে গেল। হিসাব করে দেখলাম,তিন জনের টিকিট করার টাকা আমাদের নেই। দুই খানা টিকিট করা যায়,কিন্তু না খেয়ে থাকতে হবে। খলিল ভাই একমাত্র বন্ধু, তবে তিনি তখনও ছাত্র তার কাছে টাকা পয়সা নেই। যাই হোক,আর দেড়ী না করে স্টেশনে এসে হাজির হলাম। তিন জনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম,একখান টিকিট করব এবং কোন ‘সারভেন্ট ক্লাসে’ উঠে পড়ব। যদি ধরা পড়ি, হাওরায় একটি বন্দোবস্ত করা যাবে।
প্রথম শ্রেণীর প্যাসেন্জারদের গাড়ির সাথেই চাকরদের একটা করে ছোট্ট গাড়ি থাকে ।সাহেবদের কাজকর্ম করে এই ‘ সারভেন্ট ক্লাসে ‘এসে থাকে চাকররা। দিল্লি যাওয়ার সময় আমরা ইন্টার ক্লাসে যাই। এখন টাকা ফুরিয়ে গেছে, কি করি ? একখানা তৃতীয় শ্রেনীর টিকিট কিনলাম হাওড়া পর্যন্ত। আর দুইখানা প্লাটফরম টিকিট কিনে স্টেশনের ভিতরে আসলাম। মাখনের চেহারা খুব সুন্দর। দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না ‘চাকর’ হতে পারে।আমরা শুনলাম খান বাহাদুর আব্দুল মোমেন সাহেব এই বগিতে যাবেন।নুরউদ্দিন খোঁজ এনেছে।ভাবলাম,বিপদে পড়লে একটা কিছু করা যাবে। নুরউদ্দিনকে খান বাহাদুর সাহেব চিনতেন। তিনি রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বারও ছিলেন। আমরা তার গাড়ির পাশেই সারভেন্ট ক্লাসে উঠে পড়লাম। মাখনকে বললাম, “তুই উপরে উঠে শুয়ে থাক।তোকে দেখলে ধরা পড়ব। এই সকল গাড়িতে বোধ হয় কোন রেল কর্মচারী আসবে না।” নুরউদ্দিনকে সামাল দেব যদি কেউ আসে। একবার এক চেকার সাহেব জিজ্ঞাসা করলো, “ তোমরা কোন সাহেবর লোক ?” নুরউদ্দিন ঝটপট উত্তর দিল “ মেনন সাহেব কা।” ভদ্রলোক চলে গেলেন। কিছু কিছু ফল ফলাদি নুরউদ্দিন কিনত, আমরা তিন জনে খেতাম। ভাত বা রুটি খাবার পয়সা নেই। তিন জনে ভাত খেলে তো এক পয়সাও থাকবে না। কোনমতে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছলাম, এখন উপায় কি ? পরামর্শ করে ঠিক হল,মাখন টিকিট নিয়ে সকলের মালপত্র নিয়ে বের হয়ে যাবে। মালপত্র কোথায়ও রেখে তিনখানা প্লাটফরম টিকিট নিয়ে আবার ঢুকবে।আমরা একসাথে বের হয়ে যাব।

গাড়ি থামার সাথে সাথে মাখন নেমে গেলো,আমরা দু’জন ময়লা জামা কাপড় পরে আছি। দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবে না যে আমরা দিল্লি থেকে আসতে পারি। চশমা খুলে লুকিয়ে রেখেছি। মাখন তিন খানা প্লাটফরম টিকিট নিয়ে ফিরে এসেছে। তখন প্যাসেন্জার প্রায়ই চলে গেছে। দু’চার জন আছে যাদের মালামাল বেশী। তাদের পাশ দিয়ে আমরা দু’জন ঘুরছি। মাখন আমাদের প্লাটফরম টিকিট দিল,তিন জন একত্রে বেড়িয়ে গেলাম। তখন হিসাব করে দেখি,আমাদের কাছে এক টাকার মত আছে। আমরা বাসে ওঠে হাওড়া থেকে বেকার হোস্টেলে ফিরে এলাম। না খেয়ে আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে।

( বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে  প্রকাশক এস এম সিদ্দিকুর রহমান কর্তৃক উদ্ধৃত  )

সেরা টিভি/আকিব

Please Share This Post in Your Social Media

এই ক্যাটাগরীর আরও সংবাদ
© All rights reserved by Shera TV
Developed BY: Shera Digital 360