ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক:
ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। কানফাটানো শব্দ। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের মাথার খুলি বা বিচ্ছিন্ন হাত। কেউ রাস্তায় আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে, কেউ বা প্রিয়জনকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নালায় রক্ত মিশে পানি হয়ে উঠেছে রক্তে রঞ্জিত। গত বৃহসপতিবার কাবুল বিমানবন্দরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর পরিস্থিতির এমন বর্ণনা দিয়েছেন ভাগ্যজোরে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা। পর পর দুটি শক্তিশালী বোমায় কেঁপে ওঠে আফগানিস্তানের রাজধানী শহরটি।
এতে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১১০ জন। আহত হয়েছেন আরও শতাধিক। নিহতের মধ্যে রয়েছে ১৩ মার্কিন সেনাও। আফগানদের উদ্ধার করতে যাওয়াই কাল হলো তাদের। এমন বর্বর হামলায় হতভম্ব পুরো বিশ্ব। তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকেও। হামলার দায় স্বীকার করেছে জিহাদি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-খোরাসান। এরইমধ্যে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বদলা নেয়ার হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
এদিন প্রথম হামলা হয় কাবুল বিমানবন্দরের অ্যাবি গেটকে লক্ষ্য করে। সেখানে সে সময় মার্কিন এবং বৃটিশ সেনাবাহিনী স্থানীয় লোকজনদের বিমানবন্দরে প্রবেশের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিলেন। বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার পরই সেখানে গুলি ছুড়তে শুরু করে আরেক হামলাকারী। আফগান সাংবাদিক বিলাল সারওয়ে জানিয়েছেন, প্রথম হামলার সময়ে অন্তত ২ জন সন্ত্রাসী অংশ নেয়। এরমধ্যে একজন আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। আর অন্যজন বন্দুক দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এর কয়েক মিনিট পরেই বিমানবন্দরের কাছে একটি হোটেলে দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটে। সেখানে বৃটিশ কর্মকর্তারা বৃটেনে ভ্রমণ প্রত্যাশী আফগানদের বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিলেন। আগে থেকেই এমন একটি হামলার আশঙ্কা থাকলেও মানুষ দেশ ছাড়তে মরিয়া থাকায় সেখানে জড়ো হয়েছিলেন।
চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ: কাবুল বিমানবন্দরের ওই হামলার ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। হামলার পর চারদিকে শুধু লাশ পড়ে ছিল। বার্তা সংস্থা এএফপিকে একজন জানান, কাছেই এক নালায় লাশ, মাংসপিণ্ড এবং মানুষকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। আরেকজন জানান, বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর সেখানে পুরো ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। গেট থেকে জনতাকে সরাতে তালেবান আকাশে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন বলেন, আমি আহত বাচ্চাকে হাতে নিয়ে এক ব্যক্তিকে ছুটতে দেখেছি। প্রত্যক্ষদর্শী নিজেও পরিবার নিয়ে বিমানে করে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু হামলার পর নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সব কাগজপত্র ফেলে দেন তিনি। বলেন, আমি বিমানবন্দরে আর যাব না। দেশত্যাগ আর ভিসা নিপাত যাক।
ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, জিহাদিরা যে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় তা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। বিস্ফোরণের সময় সেখানে প্রায় পাঁচশ’ মানুষ উপস্থিত ছিল বলে জানান তারা। যারা বেঁচে যান তারাই পরে হতাহতদের স্ট্রেচারে করে সরিয়ে নিতে সাহায্য করেন। সেখানে থাকা সবার পোশাকই রক্তে ভেজা ছিল।
‘এ যেন কেয়ামত’: কাবুলের মানুষের জন্য বিস্ফোরণ অপরিচিত কিছু না। তারপরও গত বৃহস্পতিবারের এই হামলা সবাইকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল। সেখানে উপস্থিত ছিল এমন মানুষরা ওই ঘটনাকে তুলনা করেছেন কেয়ামতের সঙ্গে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার এক সাবেক কর্মী। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ভিসাধারী এই ব্যক্তি হামলার সময় সেখানেই ছিলেন।
তিনি জানান, ওদিন সকালেই বিমানবন্দরের গেটে লাইনে দাঁড়ান। তার সঙ্গে ছিল আরও কয়েক হাজার মানুষ। গেট পাস করতে পারলেই তিনি আফগানিস্তান ছাড়তে পারবেন। টানা ১০ ঘণ্টা তাকে অ্যাবি গেটের কাছে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তবে তার গেট পাসের সময় হওয়ার আগেই সেখানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরিয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য আমি ভেবেছিলাম, আমার কানের পর্দা ফেটে গেছে এবং আমি আমার শ্রবণশক্তি হারিয়েছি। এরপরই তিনি সবথেকে ভয়াবহ অংশটির বর্ণনা দেন। বলেন, আমি দেখলাম আকাশে ছিন্নবিচ্ছিন্ন মানুষের নানা অংশ ছিটকে যাচ্ছে, যেন টর্নেডো শহরের মাঝ থেকে প্লাস্টিক ব্যাগ উড়িয়ে নিচ্ছে। বিস্ফোরণের পর সেখানে অসংখ্য মরদেহ দেখলাম, মানুষের বিচ্ছিন্ন অংশ দেখলাম। বৃদ্ধ, আহত মানুষের কাতরানো দেখলাম। শিশুরা আতঙ্কে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। তার ভাষায়, এই জীবনে হয়তো কেয়ামত দেখা হবে না কিন্তু কাবুল বিমানবন্দরে আমি যা দেখেছি সেটা কেয়ামতের মতোই ছিল।
২০০১ সালে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশজুড়ে সন্ত্রাসী হামলা একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়। যতভাবে সম্ভব ততভাবেই হামলা চালিয়ে গেছে তালেবান, আল-কায়েদা। শেষ দিকে এসে যুক্ত হয়েছে ইসলামিক স্টেটও। গত বৃহসপতিবারের হামলাটিও তাদেরই চালানো। গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানের মানুষ এসব হামলার সঙ্গে পরিচিত। হামলা হলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আসতো এবং মরদেহগুলোকে ব্যাগে ভরে নিয়ে যেতো। আহতদের হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতো। এই দৃশ্য কাবুলবাসীর জন্য সাধারণ বিষয় ছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবারের হামলার পর ভিন্ন দৃশ্য দেখতে হয় তাদের।
রয়টার্সকে বর্ণনা দেয়া এক কর্মী বলেন, হামলার পরে কেউ ছিল না যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। কেউ আসেনি আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বা নিহতদের সৎকারের ব্যবস্থা করতে। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোও আর চলছে না সেখানে। সেখানে থাকা বেঁচে যাওয়ারাই শেষে হতাহতদের একটা গতি করার চেষ্টা করেছেন। ওই ব্যক্তি আরও জানান, মরদেহগুলো পাশের নালায় ফেলে দিতে হয়েছে। পুরো নালা রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। আহতরা রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন। তার দাবি, শারীরিকভাবে আমি হয়তো ঠিক আছি। কিন্তু আমার মনে হয় না যে মানসিক আঘাত আমি পেয়েছি তাতে কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো।
প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা জো বাইডেনের: কাবুল বিমানবন্দরে বোমা হামলার প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ হামলার জন্য তিনি ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রভিন্স (আইএসকেপি)-কে দায়ী করেছেন। সংগঠনটিও দায় স্বীকার করেছে। পেন্টাগন বলেছে, গত বৃহস্পতিবার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল বিমানবন্দরে এক জটিল (কমপ্লেক্স) হামলা হয়েছে। এতে বহু মানুষ নিহত হয়েছে। সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্যে বাইডেন বলেন, আমরা তোমাদের দেখে নেবো। এর জন্য মূল্য দিতে হবে তোমাদের। আমার কমান্ডের অধীনে প্রতিজন মানুষকে রক্ষা করবো আমাদের স্বার্থে। তিনি হামলাকারীদের আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করারও অঙ্গীকার করেন। বলেন, আমরা ক্ষমা করবো না, আমরা ভুলবো না। আমরা তোমাদের খুঁজে বের করবো এবং এজন্য তোমাদের চরম মূল্য দিতে হবে।
এক দশকের মধ্যে মার্কিন বাহিনীর ওপর সবথেকে বড় হামলা: আফগানিস্তানে মার্কিন সেনারা আছে ২০ বছর ধরে। এরমধ্যে অসংখ্য ভয়াবহ হামলার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। তবে কাবুল বিমানবন্দরের হামলা ছিল মার্কিন বাহিনীর জন্য গত এক দশকের মধ্যে সবথেকে বেশি রক্তাক্ত। এরআগে ২০১১ সালের ৬ই আগস্ট তালেবানের হামলায় মার্কিন হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ৩০ সেনা নিহত হয়েছিলেন। এরপর কাবুল বিমানবন্দরে ১৩ সেনা হারানোই মার্কিন বাহিনীর জন্য সবথেকে মর্মান্তিক ঘটনা। হামলায় এক ডজনেরও বেশি মার্কিন সেনা আহত হয়েছেন। একইসঙ্গে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির পরে এটাই প্রথম কোনো মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার ঘটনা আফগানিস্তানে।
সেরা টিভি/আকিব