আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ড রহস্যের অবসান এখনও হয়নি। হামলায় তার লাশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। পরে তার ব্যবহৃত লাল আংটি দেখে লাশ শনাক্ত করা হয়।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, তার অবস্থান কিভাবে জেনেছিল মার্কিনিরা। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অবস্থান শনাক্ত করে তাতে নির্ভুল হামলা চালাতে সহায়তা করেছিল গুপ্তচরেরা। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে সেই তথ্য উঠে এসেছে।
কালো কাচে ঢাকা গাড়িতে করে দামেস্কো বিমানবন্দরে আসেন ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। তার সঙ্গে ছিলেন ইসলামি বিপ্লবী গার্ডসের চার সদস্য। চাম উইংস এয়ারবাস এ-৩২০ এর সিঁড়ির কাছেই থামেন তারা। বিমানটি বাগদাদ যাবে।
চাম উইংস এয়ারলাইনসের এক কর্মী রয়টার্সকে বলেন, যাত্রীদের তালিকায় সোলাইমানি কিংবা বিপ্লবী গার্ডসের সদস্যরা কেউ ছিলেন না। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকায় নিজের ব্যক্তিগত বিমান ব্যবহার এড়িয়ে গেছেন সোলাইমানি। জীবনে শেষবারের মতো কোনও যাত্রীবাহী বিমানে উঠলেন সোলাইমানি। বাগদাদ বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় তার দুটি সাঁজোয়া যানের বহরে মার্কিন ড্রোন থেকে ছোড়া রকেট হামলায় তিনি নিহত হন। বিমানবন্দরে সোলাইমানির সঙ্গে দেখা করা ইরাকি পপুলার মবিলাইজেশন ফোর্সেসের (পিএমএফ) উপপ্রধান আবু মাহদি আল-মুহান্দিসও নিহত হন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে– সোলাইমানির অবস্থান কীভাবে শনাক্ত করল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সোলাইমানির বাগদাদ আগমন নিয়ে স্পর্শকাতর নিরাপত্তা তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফাঁস করেছে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরের গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্ক। এ বিষয়টি নিয়ে এখন স্পষ্ট সোলাইমানি হত্যার তদন্তকারী ইরাকি তদন্ত দল। সোলাইমানির নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে অবগত একটি ইরাকি নিরাপত্তা সূত্র এ তথ্য দিয়েছে।
ইরাকের দুজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, ৩ জানুয়ারি মার্কিন হামলার কয়েক মিনিট পরেই ইরাকি তদন্ত শুরু হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা বিমানবন্দরটি ঘেরাও করে রেখেছে। এ ছাড়া পুলিশ, পাসপোর্ট ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাসহ কয়েক ডজন নিরাপত্তাকর্মীকে সেখান থেকে যেতে দেওয়া হয়নি।
কীভাবে দামেস্কো ও বাগদাদ বিমানবন্দরে সন্দেহভাজন সংবাদদাতারা সোলাইমানিকে শনাক্ত ও তার ওপর নির্ভুলভাবে হামলা চালাতে সহায়তা করেছেন, তদন্ত কর্মকর্তারা মূলত সেদিকেই বেশি নজর দিচ্ছেন। ইরাকের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকারী ফালিহ আল-ফাইয়াদের নেতৃত্বে এই তদন্ত চলছে। এছাড়া শিয়া মিলিশিয়াদের সঙ্গে সমন্বয়ক পিএমএফেরও প্রধান তিনি। সোলাইমানির আগমন নিয়ে স্পর্শকাতর নিরাপত্তা তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফাঁস করেছে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতর গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্ক। জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার তদন্তে এমন জোরালো আভাস রয়েছে বলে ইরাকি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সন্দেহভাজনদের মধ্যে বাগদাদ বিমানবন্দরের দুই নিরাপত্তাকর্মী ও চাম উইংসের দুই কর্মী রয়েছেন। সূত্র জানিয়েছে, দামেস্কো বিমানবন্দরে এক গুপ্তচর ওই বিমানেই অবস্থান করে কাজ করছিল। জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, গুপ্তচরদের একটি বড় গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে কাজ করেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর কাছে তথ্য ফাঁস করা চার সন্দেহভাজন। যদিও এখন পর্যন্ত তাদের কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি।
চাম উইংসের ওই দুই কর্মীর বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে সিরীয় গোয়েন্দা বাহিনী। দুই ইরাকি নিরাপত্তাকর্মী এমন তথ্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিরীয় গোয়েন্দা পরিদফতরের কাছ থেকে কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাগদাদ বিমানবন্দরের দুই নিরাপত্তাকর্মীর বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছেন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার গোয়েন্দারা। এসব গুপ্তচর দেশটির স্থাপনা নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এক কর্মকর্তা বলেন, বাগদাদ তদন্ত দলের প্রাথমিক তদন্তে এটিই বলছে যে, সোলাইমানিকে হত্যার প্রথম আভাসটি আসে দামেস্কো বিমানবন্দর থেকে। গুপ্তচরদের বাগদাদ বিমানবন্দর সেলের কাজ ছিল, তার আগমন ও গাড়িবহর নিয়ে বিস্তারিত তথ্য মার্কিন বাহিনীকে দেওয়া।
তবে এ নিয়ে জানতে চাইলে ইরাকের জাতীয় নিরাপত্তা তদন্ত সংস্থার গণমাধ্যম শাখার কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
হামলায় ইরাক ও সিরিয়ার সংবাদদাতারা কোনও ভূমিকা রেখেছে কি না তা জানতে চাইলে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, হামলার বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান শনাক্ত করে আসছে। কীভাবে এমন নির্ভুলভাবে হামলা সম্ভব হলো, তা জানতে চাইলে বলতে অস্বীকার করেছেন তিনি।
দামেস্কোর চাম উইংসের ব্যবস্থাপক বলছেন, তদন্ত বা হামলা নিয়ে কর্মীদের কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
নিরাপত্তা ক্যামরার ফুটেজের বরাতে বিমানবন্দরের দুই কর্মকর্তা বলেন, গত ৩ জানুয়ারি রাত ১২টা ৩০ মিনিটে বাগদাদ বিমানবন্দরে অবতরণ করে সোলাইমানির বিমান। বিমান থেকে বেরিয়ে কাস্টমসে না গিয়ে টারমাকের সিঁড়িতে ওঠেন তারা। বিমানের বাইরে মুহান্দিসের তার সঙ্গে দেখা করেন। পরে অপেক্ষারত সাঁজোয়া যানের দিকে তারা পা বাড়ান। আরেকটি সাঁজোয়া এসইউভিতে ওঠা সোলাইমানিকে পাহারা দিচ্ছিলেন সেনারা।
কর্মকর্তারা বলেন, বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে মূল সড়কের দিকে ধাবিত হয় তাদের গাড়িবহর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম দুটি রকেট গিয়ে আঘাত হানে সোলাইমানি ও মুহান্দিসকে বহন করা গাড়িতে। তখন রাত ১২টা ৫৫ মিনিট। পরে তাদের নিরাপত্তা সদস্যদের বহনকারী এসইউভিতে গিয়ে আঘাত হানে দ্বিতীয় মার্কিন রকেট।
হামলার কয়েক ঘণ্টা পর বিমানবন্দরের রাতের শিফটের কর্মীদের কাছে আসা মেসেজ ও ফোনকল তদন্তে মনোযোগ দেন তদন্তকারীরা। সোলাইমানির আগমনের খবর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কে ফাঁস করেছেন, তা বের করতেই এই তদন্ত করা হয়।
বিমানবন্দর নিরাপত্তা ও চাম উইংসের কর্মীদের কয়েক ঘণ্টা ধরে জেরা করেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, তাকে ছেড়ে দেওয়ার আগে অন্তত ১২ ঘণ্টা একনাগারে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
সোলাইমানি আসার আগে তিনি কাদের সঙ্গে কথা বলেছেন কিংবা বার্তা পাঠিয়েছেন, প্রথম চার ঘণ্টা তাকে সেই প্রশ্ন করা হয়েছে। তার মোবাইল ফোন জব্দ করে নিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী।
গত ৩ জানুয়ারি বাগদাদে মার্কিন গুপ্তহত্যার শিকার হন ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। পেন্টাগনের নির্দেশে তাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে।
সেরা নিউজ/আকিব