বিশেষ প্রতিবেদক:
রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বড় দুই দলের শক্তিশালী চার মেয়র প্রার্থী তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। ইশতেহারে সবাই অপরূপ এক স্বপ্নের ঢাকা শহর গড়ার অঙ্গীকার করেছেন। চারজনের প্রত্যেকেই যানজটমুক্ত, দূষণমুক্ত, সচল, ইন্টেলিজেন্ট, সুন্দর বাসযোগ্য স্বপ্নের ঢাকা নগরী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের স্লোগান- ‘সবাই মিলে সুস্থ, সচল, আধুনিক ঢাকা’। মেয়র আনিসুল হকের অকালমৃত্যুর পর গত বছর যে নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন, সেখানেও তার একই স্লোগান ছিল। সেই স্লোগান অনুযায়ী যেসব পদক্ষেপ তিনি এক বছরে নিয়েছেন, তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে ওই স্লোগান তিনি সামনে এনেছেন।
অন্যদিকে, ঢাকা উত্তরের বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ১৯ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের বিশেষত্ব হচ্ছে ‘ইন্টেলিজেন্ট সিটি’, যেখানে তিনি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর নগর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রতি জোর দিয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস গতকাল বুধবার নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছেন। এতে তিনি পাঁচটি প্রধান বিষয় সামনে এনেছেন। সেগুলো হচ্ছে- ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা এবং উন্নত ঢাকা।
১৪৪টি প্রতিশ্রুতির সবচেয়ে দীর্ঘ নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা দক্ষিণের বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন দুর্নীতিমুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক সেবা, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারসহ বিশ্বমানের বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সুশাসন ও নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার মেয়র প্রার্থীরা বরাবরই বাসযোগ্য, আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে বাস্তবে তারা ওই প্রতিশ্রুতি পালনে সফল হন না। কারণ, ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে বর্তমান ব্যবস্থায় শুধু একজন মেয়রের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এ ইশতেহার বাস্তবায়নে এগিয়ে না এলে একজন মেয়রের পক্ষে কার্যত কিছুই করার নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, একজন মেয়রকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে হলে নগর সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিকল্প নেই।
ইশতেহারে বাসযোগ্য ঢাকার স্বপ্ন : ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে বসবাসের জন্য অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান তিন নম্বরে। এক নম্বরে আছে নাইজেরিয়ার লাগোস এবং দুই নম্বরে সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর দামেস্ক। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে ঢাকার অবস্থান ছিল দামেস্কের নিচে, অর্থাৎ বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।
বসবাসের অযোগ্য শহর বলেই যারা মেয়র প্রার্থী হন, তাদের প্রথম প্রতিশ্রুতি থাকে ঢাকাকে বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলা। এবারের নির্বাচনেও চার হেভিওয়েট প্রার্থীর ইশতেহারের মূল আকর্ষণ ঢাকাকে বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলা। ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে গিয়ে তারা কী পদক্ষেপ নেবেন, সেখানে কিছু বিশেষত্ব এবং সামান্য তারতম্য রয়েছে একেকটি ইশতেহারে।
চার প্রার্থীই ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য ঢাকার প্রধান সমস্যাগুলো দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যেমন- দূষণমুক্ত, যানজটমুক্ত, দখলমুক্ত ও আবর্জনামুক্ত পরিচ্ছন্ন ঢাকা উপহার দেবেন তারা। মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম এর বাইরে সবাইকে নিয়ে সুস্থ ঢাকা গড়ে তোলার জন্য বিশেষ ধরনের অ্যাপ প্রবর্তনের কথা বলেছেন। যার মাধ্যমে নগরবাসী যে কোনো সমস্যার কথা জানাতে পারবেন, সরাসরি মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন, ফলে দ্রুত সমাধান দেওয়াও সহজ হবে। এক বছর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আতিকুল ইসলামের ভাষায়, এমন একটি ব্যবস্থাপনা তিনি গড়ে তুলতে চান, যেখানে রাজধানীবাসী সবাই মূলত মেয়রের ভূমিকায় থাকবেন। তিনি রাজধানীবাসীর নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সেবা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকবেন। এবারের ইশতেহারে তিনি জনপ্রিয় ‘নগর পিতা’র ধারণা বদলে দিয়ে ‘নগর সেবক’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। তার স্পষ্ট বক্তব্য- তিনি ‘নগর পিতা’ হতে চান না, ‘নগর সেবক’ হতে চান।
ঢাকা উত্তরের অন্য হেভিওয়েট প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য ওয়ার্ড পর্যায়ের বিকেন্দ্রীকরণ, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটিকে মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্ট অথরিটিতে রূপান্তর, কর্মীদের পে রোল ও কর্মকর্তাদের ক্যারিয়ার সার্ভিসের আওতায় আনা, নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিসহ নগর সরকার ধারণা বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। একই সঙ্গে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে ‘ইন্টেলিজেন্ট সিটি’ হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলার কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিনামূল্যে নিরাপদ ওয়াই-ফাই, ওভারহেড ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড, অ্যাপের মাধ্যমে নাগরিক সেবা, ডাটা অ্যানালিটিকস ডিপার্টমেন্ট, গুণমান পরিচালন ব্যবস্থা (কিউএমএস), সার্ভিস কোয়ালিটি ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং অনলাইনে ট্যাক্স আদায়ের ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন।
ঢাকা দক্ষিণের হেভিওয়েট প্রার্থী ফজলে নূর তাপস তার ইশতেহারে ঐতিহ্যের ঢাকা এবং সুশাসিত ঢাকার প্রতি জোর দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলেছেন। ইশতেহারে তিনি বলেন, চারশ’ বছরের পুরোনো ঢাকার রয়েছে নিজস্ব ইতিহাসের উজ্জ্বল ছবি, ঐতিহ্যের গভীর শেকড় এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব। সবাইকে নিয়ে সমন্বিত প্রয়াসে জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি নির্মাণ এবং প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। নগরীর ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণ করে ঢাকাকে তার স্বকীয় ঐতিহ্যে বিশ্বের দরবারে নতুন রূপে সাজিয়ে তোলা হবে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কার্যকর এবং এলাকায় সংশোধন কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে সুশাসিত ঢাকা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে ব্যারিস্টার তাপস বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হবে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশায়িত প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে প্রথম দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা।
ঢাকা দক্ষিণের অপর হেভিওয়েট প্রার্থী ইশরাক হোসেন নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকাকে ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ের দলীয় ইস্যুও সামনে এনেছেন নির্বাচনী ইশতেহারে। তিনি ইশতেহারের শুরুতেই বিএনপির জাতীয় রাজনীতিতে গত কয়েক বছরের স্লোগান ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’র বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এর বাইরে তিনি ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য গণশুনানির মাধ্যমে নগরবাসীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ, হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিমুক্ত করা এবং অনলাইনে ট্যাক্স আদায়ের ব্যবস্থা করা, করপোরেশনের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। জন্ম-মৃত্যুসনদ, ট্রেড লাইসেন্স এবং অন্য সব ধরনের সেবা তাৎক্ষণিক প্রদানের লক্ষ্যে দ্রুত ও জবাবদিহিমূলক ওয়ান স্টপ সাভিস চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। কেন্দ্রীভূত সব নাগরিকসেবা কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে ওয়ার্ড পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণও করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য প্রার্থীদের ইশতেহার :প্রতিশ্রুতি, স্বপ্নের জাল আর সুবচন যতই থাকুক, বাস্তবে প্রার্থীদের ইশতেহার কতটা বাস্তবায়নযোগ্য- তা নিয়ে নগরবাসীর মনে থাকছে এক বিশাল প্রশ্ন। কারণ, রাজধানী ঢাকায় নগরবাসীর সেবা ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশনের বাইরে সরকারি নানা সংস্থার ওপর ন্যস্ত। আইন ও বিভিন্ন বিধি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নগরবাসীর সেবাদানকারী কোনো সরকারি সংস্থার ওপরই মেয়রের একক নিয়ন্ত্রণ নেই। এ সংস্থাগুলো সিটি করপোরেশনের কোনো আদেশ, অনুরোধ মানতেও বাধ্য নয়। নগরবাসীর সেবা ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব বহুকাল আগে থেকেই রয়েছে। নতুন নির্বাচিত মেয়ররা কীভাবে দীর্ঘকালের এ সংকট মোকাবিলা করে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করবেন- এ প্রশ্ন নগরবাসীর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি মোবাশ্বের হোসাইন বলেন, যত বড় আর যত সুন্দর ইশতেহারই দেওয়া হোক না কেন, তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত নগর সরকার ব্যবস্থা চালু না হবে। তিনি বলেন, একজন নির্বাচিত মেয়রের ক্ষমতা কিন্তু কাগজে-কলমে অনেক। কারণ, জাতীয় সংসদ চাইলে অনাস্থা ভোট এনে মেয়াদের আগেই প্রধানমন্ত্রী বদল করে ফেলতে পারে; কিন্তু সিটি করপোরেশনের একজন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তাকে সরানোর কোনো সুযোগই নেই। কাগজে-কলমের এ ক্ষমতা বাস্তবে শূন্য। কারণ, ঢাকায় নগর সেবা ব্যবস্থাপনা অনেকগুলো সরকারি সংস্থায় বিভক্ত, যেগুলোর কোনোটির ওপরই মেয়রের নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব সংস্থা চলে পুরো আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, সরকারের অধীনে। যেমন যানজট দূর করতে হলে মেয়রের অধীনে পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ তো মেয়রের নিয়ন্ত্রণে নয়। একইভাবে ঢাকা ওয়াসা, রাজউক, বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ- কোনো কিছুই তো মেয়রের অধীনে নয়। এর আগে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক যখন গুলশানে ফুটপাত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলাচলের উপযোগী করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তখন বাদ সেধেছিল বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষের খুঁটি। সেই খুঁটি স্থানান্তর করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। অতএব, এটা খুব স্পষ্ট যে নগর সরকার ব্যবস্থা ছাড়া একজন মেয়রের পক্ষে সফলভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সংবিধানেই নগর সরকার ব্যবস্থার কথা বলা আছে। দরকার শুধু বাস্তবায়ন করা। এটা বাস্তবায়ন করা গেলে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অংশগ্রহণে নগর সংসদ হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে শিক্ষিত ও আরও যোগ্য ব্যক্তিরা প্রার্থী হতে আগ্রহী হবেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার হলো প্রার্থী আর ভোটারদের মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তির মতো, যেখানে স্বাক্ষর থাকে না। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের আগে প্রার্থী ভোটারের কাছে নিজের দায়বদ্ধতার বিষয়টি পরিস্কার করেন। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নির্বাচনের পর নির্বাচিতরা ইশতেহার ভুলে যান। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। কারণ, আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে না। আসলে পুরোনো প্রতিশ্রুতি নতুন করে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ সুশাসিত ঢাকার জন্য পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলেছেন। অথচ ঢাকার বর্তমান বাস্তবতায় এ ব্যবস্থার প্রবর্তন অসম্ভব; বরং এর পরিবর্তে যদি সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, সমন্বিত ও সুব্যবস্থাপনা গড়ে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হলে নগর সরকার ব্যবস্থা চালুর কোনো বিকল্প নেই।
সেরা নিউজ/আকিব