তৎকালীন বিশ্বের সকল পরাশক্তি ও বেশীর ভাগ রাষ্ট্রই এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দুটি বিপরীত সামরিক জোটের সৃষ্টি হয়। মিত্র শক্তি ( Allied Powe) আর অক্ষ শক্তি (Axis Power) এ যুদ্ধে ৩০টি দেশের সব মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশী সামরিক সদস্য অংশ গ্রহন করে।
বেসামরিক জনগনের উপর জার্মানির হিটলারের নির্বিচার গনহত্যা( বিশেষ করে ইহুদিদের উপর চালানো গনহত্যা) ,মিত্র শক্তির মাত্রাতিরিক্ত হিটলার তোষন নীতিই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্যতম কারন, পূর্ব এশিয়ায় একছত্র আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে জাপান ১৯৩৭ সালে চীন আক্রমণ করে। ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বরের জার্মান পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। শুরু হয়ে যায় মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ যাবত কালের সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ।
১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত একনাগারে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালনা আর চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে জার্মানি ইতালীর সাথে একটি মিত্র জোট গঠন করে এবং ইউরোপ মহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল নিজেদের দখলে বা নিয়ন্ত্রনে আনতে সমর্থ হয়। মলোটব- কিবেন্ট্রপ চুক্তি অনুসারে জার্মানি আর সভিয়েট ইউনিয়ন তাদের দখলকৃত পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। ১৯৪১ সালে জুন মাসে অক্ষ শক্তি (Axis Power ) সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে যার ফলশ্রুতিতে সমর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ রনাঙ্গনের অবতারনা ঘটে। স্টালিন গ্রেডের যুদ্ধ নিয়ে বহু ছায়াছবি নির্মাণ করা হয়েছে।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে জাপান অক্ষ শক্তিতে যোগদান করে এবং প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে সর্ববৃহৎ নৌঘাঁটি পার্ল হাড়বার আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করে দেয়। এছাড়া জাপান এশিয়ায় এবং প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো আক্রমণ করে এবং অতি দ্রুততার সাথে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করতে সক্ষম হয়। ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র মিত্র শক্তির(Allied Power) সাথে যোগ দেয়। মূলত জাপান যুক্তরাষ্ট্রের পার্রল হাড়বার আক্রমণের মাধ্যমে একে যুদ্ধে ডেকে আনে। অপরদিকে চীনের সাথে জাপানের ছিল পুরাতন শত্রুতা, ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি থেকেই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। এরফলে চীন ও মিত্র পক্ষে যোগদান করে।
পোল্যান্ড আক্রমণ: নাৎসি বাহিনী বিনা ঘোষনার হঠাৎ করে পোল্যান্ড আক্রমণ করে বসে আর এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ । সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিষ্ক্রিয় রাখার জন্য জার্মান পূর্বেই সোভিয়েতের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করে ছিল। অন্যদিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স পোল্যান্ডের সাথে সহায়তা চুক্তি করেছিল। ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ শুরু হয়। ৩য় সেপ্টেম্বর মিত্র বাহিনী জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
প্রথম দিনই জার্মান ঝটিকা বাহিনী পোল্যান্ডকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয়। হঠাৎ আক্রমণে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। ফরাসি ও ব্রিটিশ বাহিনী পোল্যান্ডকে সাহায্য করার সুযোগ পেল না।
সোভিয়েত ও ফিনল্যান্ড যুদ্ধ: জার্মান ও মিত্র পক্ষের যুদ্ধ চলাকালীন সভিয়েট ইউনিয়ন ১৯৩৯ সালের ৩০ নভেম্বর ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে। ফিন দের লোকবল খুবই কম হওয়া সত্বেও তাদের দেশ রক্ষার প্রবল ইচ্ছা ছিল। নতুন বছরের ২রা ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত বিমান,ট্যাঙ্ক ও স্লেজ বাহিত সেনাবাহিনী একযোগে ফিনদের প্রতিরক্ষা রেখায় আক্রমণ করে। ১৯৪০ সালে ৬ মার্চ ফিনল্যান্ড শান্তির জন্য আবেদন করে। সার্বভৌমত্ব রক্ষা পেলেও লেনিনগ্রাদের কাছাকাছি বেশ কিছু এলাকার মালিকানা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ফিনল্যান্ড। এ যুদ্ধে দুই লক্ষ ফিন সৈন্যের মধ্যে সত্তর হাজার সৈন্য মারা যায়।
এরপর নরওয়ে, ডেনমার্ক এর যুদ্ধ , হিটলার কর্তৃক ফ্রান্স,বেলজিয়াম,নেদারল্যান্ড, লুক্সোমবার্গ আক্রমণ,বলকান যুদ্ধ,উত্তর আফ্রিকা এবং ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অক্ষশক্তির অভিযান ও যুদ্ধ চলতে থাকে।
অক্ষশক্তি কতৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ : মূলত পূর্ব ফ্রন্ট নামে অধিক পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিককার যুদ্ধের প্রধান আঁচ ছিল পশ্চিম ইউরোপিয় দেশ গুলির উপর। সে সব দেশগুলি দখলের মাধ্যমে জার্মানির বেশ ভাল রকমের রসদ পেয়েছিল যুদ্ধ চলিয়ে যাবার জন্য। ফ্রান্সকে মাত্র ১ মাসের মধ্যে হারিয়ে দিয়ে হিটলার জার্মান জাতীর উপর ১ম বিশ্বযুদ্ধের অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে ফেলে। উদ্ভূত অবস্হার পরিপ্রক্ষিতে জার্মানি,জাপান ও সোভিয়েত রাশিয়া প্রস্তুতি নিতে থাকে। জাপানের সাথে রাশিয়ার অনাক্রণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। জার্মানি রাশিয়ার সাথে একটা মতৈক্যে আসার চেষ্টা করছি,কারন সেই সময়টায় হিটলারের লক্ষ ছিল ইংল্যান্ডেকে বসে আনার। ইংল্যান্ড যাতে করে আমেরিকা ও রাশিয়াকে যুদ্ধে টেনে আনতে না পারে সেই লক্ষে হিটলার রাশিয়ার সাথে একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল একই সাথে রাশিয়া আক্রমণের জন্য সীমান্তে বিশাল সৈন্য সমাবেশ করছিল।যদি সে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করতে ব্যার্থ হয় তবে যুদ্ধের মাধ্যমেই চুড়ান্ত ফয়সালা করবে। বনিবনা না হওয়ায় রাশিয়া জার্মানি চুক্তি হলো না। ১৯৪০ সালের ১৮ ডিসেম্বর হিটলার রাশিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তার সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। ২২ জুন , ১৯৪১ সালে জার্মানির মিত্র ইতালী ও রুমানিয়াকে নিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে।
এই অভিযান ‘ অপারেশন বার্বারোস ‘ নামে পরিচিত।এই অভিযানের মূল লক্ষ ছিল ১৯৪১ সালের মধ্যে রাশিয়ার বিশাল উর্বর ভূমি ও শিল্পাঞ্চলে সমূহের দখল নেয়া, কমিনিউজমের বিনাশ করা এবং পরবর্তী শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় রসদ যোগানো।
পার্ল হারবার আক্রমণ : ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ নৌ ঘাঁটি হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত পার্ল হারবার আক্রমণ করে। হাওয়াই দ্বীপে ওই দিন ছুটির দিন ছিল। ৬টি বিমানবাহী জাহাজ থেকে ৩৫৩ টি যুদ্ধ বিমান, বোমারু বিমান এবং টর্পেডো নৌ ঘাটিতে একযোগে আক্রমণ করে। চারটি মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ তাৎক্ষনিক ভাবে ডুবে যায় এছাড়াও অন্য চারটি যুদ্ধ জাহাজ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।জাপান পরিচালিত এ বিমান আক্রমণে ১৮৮ মার্কিন যুদ্ধ বিমান ধংশ হয়,নিহত হয় ২৪০২ জন, আহত হয় ১২৮২ জন। জাপানের ক্ষয়ক্ষতি ছিল খুবই সামান্য ২৯ টি যুদ্ধ বিমান ভূ-পতিত হয় এবং ৫টি সাবমেরিন তলিয়ে যায়। হামলাকারীদের মধ্যে ৬৫ জন নিহত হয়। পর দিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর, ১৯৪১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরূদ্ধে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধ ঘোষনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় জার্মানি ও ইতালি ১১ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষনা করে। যুক্তরাষ্ট্র ওই একই দিন যুদ্ধ ঘোষনা করে এবং সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পরে।
পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ : যুদ্ধের শেষ পর্যায় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করে।১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমা ও ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরে যুদ্ধ বিমান যোগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেনরী এস ট্রুম্যানের নির্দেশে পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এর ৬ দিন পর ১৫ই আগস্ট জাপান আত্মসমর্পণ করে।
হতাহতের সংখ্যা : হিরোশিমায় ২০,০০০
সৈন্য ৬০,০০০ সাধারন নাগরিক, নাগাসাকিতে ৪০,০০০ মোট ১,২০,০০০ মানুষ নিহত হয় এবং পারমানবিক বোমার তেজক্রিয়ায় পরবর্তীকালে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয় অথবা চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।
যুদ্ধের পরিসমাপ্তি : – ২ মে , ১৯৪৫ সালে ‘ব্যাটেল অব বার্লিন’ শেষ হয়।মিত্র বাহিনী বার্লিন প্রবেশ করে ও জার্মানির বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে। পূর্ব ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫ এডলফ হিটলার ও তার একদিনের স্ত্রী ইভা ব্রাউন বার্লিনের বাংকারে আত্মহত্যার করে। এভাবেই সমাপ্ত হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ ।
২য় বিশ্বযুদ্ধের মোট হতাহতের সংখ্যা : – সামরিক প্রান হানি (মিত্র পক্ষ )- ১,৬০,০০০,০০ বেশী, বেসামরিক প্রানহানি – (মিত্র পক্ষ) ৪, ৫০,০০,০০০ সর্বমোট প্রানহানি (মিত্রপক্ষ) ৬,১০,০০,০০০ , সামরিক প্রানহানি ( অক্ষ শক্তি) ৮০,০০০,০০ বেসামরিক প্রানহানি – (অক্ষ শক্তি) ৪০,০০০,০০ সর্বমোট প্রানহানি – ( অক্ষ শক্তি)- ১,২০,০০,০০০
২য় মহাযুদ্ধের ফলাফল :
১। মিত্র পক্ষের বিজয় ।
২। নাজি জার্মানি,ফ্যাসিস্ট ইতালি,ও জাপান সামরাজ্যবাদের শোচনীয় পরাজয়।
৩। মিত্র বাহিনী জার্মান,জাপান,ইতালি ও অস্ট্রেরিয়া দখল করে ও রাজতন্ত্রের পরিবর্তে ইতালিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়।
৪। পারমানবিক যুগের সূচনা হয়।
৫। লীগ অব ন্যাশন- এর অবলুপ্তি ও জাতিসংঘের সৃস্টি হয়।
৬।বিভিন্ন দেশের সরকার ব্যবস্হায় আমুল পরিবর্তন ঘটে।
৭।বিশ্বের মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলে।
——————————————————————
আজ থেকে ৮২ বৎসর পূর্বে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে।শুরু হয়ে যায় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। আজ সেই কালো দিবস ১লা সেপ্টেম্বর। ওই সর্বনাশা যুদ্ধে কোটি, কোটি সামরিক,বেসামরিক মানুষের হতাহতের কথা,বিশ্বব্যাপী মহা বিপর্যয় ও হা-হা কার এর কথা স্মরন করে ও সকল নিহত হতভাগ্য মানুষদের আত্মার শান্তি কামনা করে পোস্টটি দিলাম।
সেরা টিভি/আকিব