হাসান মাহমুদ, নিউইয়র্ক থেকে:
উন্নত দেশে বাংলাদেশিরা শুধু ওভারই চালায় না। তাঁরা পুলিশের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি) অত্যন্ত চৌকস ও মেধাবি অফিসারদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। ২০০৬ সালে লে. সুজাত খানই প্রথম বাংলাদেশি পুলিশ অফিসার হিসেবে ‘এনওয়াইপিডি’তে পরিচিত ছিলেন। তিনি আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারি বাংলাদেশি অফিসার হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। এখন নিউইয়র্কে বাংলাদেশি আমেরিকান ইউনিফর্মধারি ৪ শতাধিক পুলিশ সদস্যের মধ্যে অফিসার রয়েছেন ২৫৮ জন। যারা উচ্চ পদের দিকে দিনদিন এগিয়ে যাচ্ছেন। এখন নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কান পাতলেই বাংলায় কথা বলতে শুনা যায়। ‘এনওয়াইপিডি’র শীর্ষ পদে সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেন ক্যাপ্টেন খোন্দকার আবদুল্লাহ (৩৩)। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশি আমেরিকান হিসেবে তিনি রিতিমতো ইতিহাস গড়লেন। আগামীতে তাঁর নিউইয়র্কের কমিশনার হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আমেরিকার মূলধারার প্রভাবশালি গণমাধ্যম তাঁকে নিয়ে অনেক প্রশংসামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। লে. সুজাত বলেন, এটা সত্যি গর্বের এবং আকর্ষণিয়ও বটে। বিপুল সংখ্যক অফিসার ও সদস্য এখন কর্মরত রয়েছেন নিজেদের মেধা ও যোগ্যতায়। নিউইয়র্ক রাজ্যটি আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে বড় এটি এলাকা। আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ নগরি হিসেবে মানুষের সেবা ও সহযোগিতায় পুলিশ বিভাগের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে।
‘এনওয়াইপিডি’র কমাণ্ডিং অফিসার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ব্রুকলিনের ৬৯ প্রিসেন্টে যোগ দিয়েছেন ক্যাপ্টেন খোন্দকার আবদুল্লাহ। ধারণা করা হচ্ছে, ক্যাপ্টেন খোন্দকার আবদুল্লাহ সরকারী গ্রিণ সিগন্যাল পেলে আগামীতে প্রথম বাংলাদেশি আমেরিকান হিসেবে নিউইয়র্ক সিটির পুলিশ কমিশনার হতে যাচ্ছেন। ‘এনওয়াইপিডি’তে চলতি ২০ সেপ্টেম্বর তিনি নিউইয়র্ক সিটির কমান্ডিং দায়িত্ব নিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি বাংলাদেশের সিলেট থেকে বাবা মার সাথে আমেরিকায় অভিবাসি হন। পড়ালেখা শেষ করে ২০০৫ সালে এনওয়াইপিডি’তে যোগ দেন। ২০০৭ সালে পুলিশ অফিসার হিসেবে শপথ নেন খোন্দকার আবদুল্লাহ। নিউইয়র্কের অপরাধমূলক এলাকা ব্রুকলিনে তিনি দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘসময়। সাদা পোশাকের পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তার দক্ষতার পরিচয় মেলে ‘এনওয়াইপিডি’তে। ২০১৬ সালের আগস্টে খন্দকার আবদুল্লাহ লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি পান। পদোন্নতির পর তাঁকে নিউইয়র্ক সিটির ২৮ প্রিসেন্টে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁর সততা, দক্ষতা, অপরাধ দমনে দ্রুত কৌশলের কারণে তিনি সর্বমহলে পরিচিতি পান। খোন্দকার আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমি, আমার পরিবার, সহকর্মী ও বাংলাদেশি কমিউনিটি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি।’
বেশি দিন আগের কথা নয়। মাত্র দশ বছর আগেও নিউইয়র্ক পুলিশ ডিটার্টমেন্টে উচ্চ পদে বাংলাদেশিদের কোন অবস্থান ছিলো না। যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস তৈরি করলো। গত বছর (২০২০) অক্টোবরে ১৪ জন বাংলাদেশি আমেরিকান নিউইয়র্ক পুলিশ অ্যাকাডেমি থেকে সাফল্যের সাথে গ্রাজুয়েট ডিগ্রী অর্জন করেছেন। লে. সুজাত খান (৩৮) জানান, নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কোন কমান্ডিং লেবেলে গেলে অন্তত একজন বা দুইজন বাংলাদেশি আমেরিকান অফিসারকে পাওয়া যাবেই। এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয় আমাদের কাছে। লে. সুজান খান ২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ এসোসিয়েশনে’র প্রতিষ্ঠাতা কো-ফাউন্ডার হিসেবে পরিচিত। এই সংঠনের সূত্র ধরে নিউইয়র্ক পুলিশে বর্তমানে পুরুষ ও নারী সদস্যের সংখ্যা ৪ শতাধিক। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, ‘আমরা আমাদের মসজিদে যাচ্ছি, মন্দির ও গির্জায় যাচ্ছি। নিজেদের দায়িত্ব পালন করছি। কমিউনিটির দিকেও কড়া নজর রাখছি’।
বাংলাদেশি আমেরিকান নারী পুলিশ কর্মকর্তা তান্নি চন্দ (২৮) নিউইয়র্কে ‘ক্রিমিনাল জাস্টিজ’ বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে ‘এনওয়াইপিডি’তে অফিসার হিসেবে ৩ বছর আগে যোগদান করেন। বাংলাদেশের মৌলভিবাজারের মেয়ে তান্নি ১১ বছর বয়সে বাবা মায়ের সঙ্গে আমেরিকায় আসেন। তিনি বলেন, ‘স্কুলে যাবার সময় নগরীতে পুলিশ অফিসারদের দেখে আমার খুব ভালো লাগতো। ডিটেকটিভ স্টোরি দেখতাম। দেখতে দেখতে নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সির অধিনে গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম ‘জন জ্য কলেজ’ থেকে। নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির অধিনে এই সিনিয়র কলেজটি ‘ক্রিমিনাল জাস্টিজ’ বিষয়ে পড়ালেখার উপযুক্ত স্থান। রেজাল্টের দিনটি ছিলো সত্যি আনন্দের। আমার বাবা খুবই গর্ব করতে লাগলেন আমার ফলাফল দেখে। পরিবারের একমাত্র সদস্য হিসেবে আমি পুলিশ অ্যাকাডেমিতে যাওয়া শুরু করলাম। বাবা এবং পরিবারের সদস্যরা পুলিশের চাকরি মেয়েদের জন্য উপযুক্ত স্থান নয় বলেই মত দিতে থাকলেন। বাংলাদেশি পরিবারগুলো অত্যন্ত রক্ষণশিল হয়ে থাকে। তারা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে মেয়েদের যোগদানের পক্ষে থাকে না। তবে যারা ছোটবেলা থেকে আমেরিকায় বড় হয় তারা নিজেদের স্বাধীন কর্মক্ষেত্র হিসেবে পুলিশ বিভাগকে বেছে নেয়। এটা সত্যি চ্যালেঞ্জিং পেশা।’
তান্নি জানান, ‘এক সময় এনওয়াইপিডিতে যোগদান করলাম। পড়ালেখায় ভালো হবার কারণে দিনদিন আমার অবস্থান ও সম্মান বাড়তে থাকে।’ ব্রুঙ্কস এর একটি এলাকায় তান্নি চন্দ দায়িত্বশিল হন। এখানে আরও ১২ জন বাংলাদেশি আমেরিকান নারী পুলিশ সদস্য কর্মরত আছেন। তান্নির বক্তব্য এবং সহকর্মীদের মধ্যে আলাদা ইমেজ তৈরির সাথে সাথে তার বাবা ভাবলেন মেয়ে তার সঠিক কাজটিই করেছে, বললেন তান্নি।
এনওয়াইপিডি’র সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা লে. সুজাত খান মনে করছেন, যেভাবে বাংলাদেশি আমেরিকানরা পড়ালেখা শেষ করে নিজের যোগ্যতা দিয়ে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে যোগদান করছেন তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নিউইয়র্কে নাগরিকদের সেবা প্রদানে এক অনন্য দৃষ্টান্ত করতে চলেছে বাংলাদেশি আমেরিকানরা।
সেরা টিভি/আকিব